সামনের দালানের এক হতভাগা নারী গতকাল ভোরে আত্মহত্যা করার জন্য ছাদ হতে লাফ দিয়েছে।
বয়স হয়েছে। রাতে এখন আর নিরবচ্ছিন্ন ঘুম হয় না। তাতে অবশ্য খুব একটা ক্ষতি হয়নি। অতি ভোরে ঘুম ভাঙে। পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা হয়। এই কর্কশ শহরে পাখির ডাক শোনাও তো ভাগ্যের ব্যাপার। আলহামদুলিল্লাহ।
কাল ভোরে ঘুম ভাঙল ও পাড়ের গলির মধ্যে হৈ চৈ শুনে। ছোটলোকদের পাড়ায় আমি আরেক ছোটলোক থাকি। চিল্লাচিল্লি এখানে নতুন না। আমাদের মতো ছোটলোকদের ঘুঁপচি এপার্টমেন্টগুলোর বাসিন্দারা যা কিছুই করে, সশব্দে করে। শোরগোল না করে এরা কিছু করতে পারে না।
পাশের বাসার ৩৫ শে পা দেয়া বিয়েযোগ্যা ছন্দাকে ওর মা যখন বিয়ে না হওয়ায় নিষ্ঠূরভাবে গালাগালি করে, অথবা তিন বাসা পরে নিচতলার হোসেন আলী যখন বউটাকে ‘খা*কী *গী’ বলে বেদম পেটায়, তখন আমরা, প্রতিবেশী পুরুষরা একরকম জৈবিক সুখ অনুভব করি। হোসেনের বউয়ের নির্মম আহাজারি শোনার ফাঁকে ফাঁকেই ঘরের বউকে কেউ গালি দিয়ে বসে, “ওই অবাগীর বেটি, ছালুনে নুন এত বেশি দিছস ক্যাঁ।”
ঘরের মেয়েছেলেরাও কম যায় না। সাথে সাথে কোলের গ্যাঁদা ছাওয়ালকে দুধ দিতে দিতেই উত্তর পাড়ে, “এ্যারচে ভাল ছালুন খাতি ওলি মাইয়াছাওয়ালরে পালতি পারার মুরোদ থাকতি অয়।” পদ্মানদীর মাঝির কূবেরের গাঁয়ের মতো এখানেও ঈশ্বর তিন ব্লক দূরের হাউজিং পল্লীর এপাড়টা খুব একটা মাড়ান না।
ঘূ ঘূ ডাকা চৈত্রের দুপুর অথবা নিশুতি মাঝরাতে নিচের তলার বাসিন্দা পুরুষ মাতাল হয়ে ফিরেই যখন বউয়ের কাছে প্রণয় ভিক্ষা করে, বউটা প্রচন্ড ক্ষেদে কুৎসিত গালাগাল করে, আর তারও পরে, মাঝ রাতের নিরবতা খান খান করে পুরুষের গোঁ গোঁ এর সাথে দেহ মোচড়ানো সাপের মতো নারীর তীব্র শিৎকার ভেসে আসে, বোঝা যায়, এই অভদ্র, ছোটলোকের পাড়াতেও দেবতা কিউপিড পদার্পন করলেন, সশব্দে।
আমার মনে পড়ে যায় ডার্টি পিকচারে বিদ্যার ডায়লগের কথা, ”ছালে কমিনে। কই ভি কাম বিনা শোর সে নেহি কার সাকে।”
অথবা, বলতে পারি, পাশের দালানের মর্জিনাদের ঘরের কথা। ভোর না হতেই তাদের বাসায় শুরু হয়ে যায় অভাবের নগ্ন হানার ঝনঝনানি। মর্জিনার মা সশব্দে হাড়িপাতিল নাড়েন। অভাবের তীব্র ছোবলে ক্লিশ তার জীবনে এই প্রতিবাদটুকুই যেন খোদার বিরুদ্ধে, গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবার একমাত্র পথ। তাদের হাড়িকুড়ির ঝনঝনানিতে ঘুম ভাঙে। বি
রক্ত মুখে উঠেই ছুটি ’পায়খানায়’। বয়স হয়েছে। এখন আর বেগ ধরে রাখা যায় না। কিডনীতে পাথর না কী যেন জমেছে। সে জানান দিচ্ছে বহুদিন। গা করছি না। উপায় নেই গা করার। গা করলেই একগাদা পয়সা চলে যাবে ট্যাঁক হতে। বাড়িঅলা রোজ আসছে, ভাড়া বাড়ানোর ধান্দা।
‘পায়খানায়’ বসেই আমি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির ঘন্টা শুনি। মানুষজনের চাঁপা ফিসফিস, মরে নাই, মরেছে, ছেনাল মাগি………জামাইডা একডা শুয়ার……ইত্যকার শব্দ শুনি। শুরুতে যদিও ভেবেছিলাম, হয়তো আগুন লেগেছে, অথবা গ্রিল কেটে চুরি। লাগুক, চুরি হোক, আমার কী? ছোটলোকদের ঘরে কী এমন থাকে, যেটা চুরি হবে? আমি গতকাল রাতের স্ফিত ইনটেসটাইন শুন্য করায় মন দিই।
হালকা হয়ে বেড়িয়ে ঘুঁপচি মতো বারান্দায় দাড়িয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা বিফল হল। কেবল কিছু উৎসাহি মানুষের লুঙ্গির খুট তুলে পাছা চুলকানোর দৃশ্য ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। এই এত ভোরেও তারা সেন্ডু গেঞ্জি গায়ে, রাতের অসুখী ’প্রণয়ের সাক্ষর’ সম্বলিত লুঙ্গী পরে মজা দেখতে আসতে ভুল করেনি। ছোটলোক পাড়ার এটাই রীতি। এরা কাউকে সাহায্য না করুক, কারো অপমান, বিপদ দেখে মজার ভাগ নিতে ওস্তাদ। নেবেই বা না কেন? অভিশপ্ত এ পাড়ায়, স্থূলদেহী মালায়লাম নায়িকার মাংসল দেহের নৃত্য বাদে এটাই সবচেয়ে বড় বিনোদন। একদম লাইভ। তাতে আমার কী?
যথারীতি গরম ভাত আর আলু ভর্তায় পেট ভরে অফিসে গিয়েছি। গতবার ইদে ভায়রা ভাইয়ের গিফট করা সস্তা পারফিউম দিতে ভুলিনি। রাতে ক্লান্ত বিদ্ধস্ত ঘরে ফেরার সময় বাসার বুড়ো দারোয়ান অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে জানালো,
”ওই বাড়ির মতির বউডা কাইল বিয়ান রাইতে জামাইর লগে ঝগড়া হইর্যা ছাদের থোন লাফ দিছিল। চাইর তালার ছানছাইডে বাইধ্যা ঝুইল্লা আছিল। পুলিশ আর ফায়ার শারভিশ আইয়া নামাইয়া লইয়া গ্যাছে গা। মুখ ভ্যাচকাইয়া গ্যাছে। রক্তে ভাইস্যা গ্যাছে।” বুড়ো দারোয়ানের চোখে অন্যরকম দ্যুতি খেলা করে। যেন সে বার্সেলোনা আর রিয়াল ম্যাচের ধারাবিবরনী দিচ্ছে।
”ক্যান লাফ দিছে?” ”সবাই তো কয়, পিড়িত করতে যাইয়া ধরা খাইছে।” মাইয়া মানুষ, স্বামীর পরকীয়া ধরে ফেলায় খুন হল কিনা-সেই প্রশ্ন অবশ্য আমি দারোয়ানকে করি না।
কেন করব? আমার কী? আমি চকচকে চোখে জিজ্ঞেস করি, “মরছে”?
”না, মামা, মরে নাই। মাইয়া মানুষ এত সহজে মরে নি?”
সিঁড়ি ভাংতে ভাংতে আমি ভাবি, তাই হবে। তাই হবে। ”মেয়ে মানুষ এত সহজে মরে না”। [জঘন্য এক মানসিক বিক্ষুদ্ধতার ভিতরে এই লেখার জন্ম। কুৎসিত ভাষা ও জঘন্য গল্পের সেটাই কারন। গতকাল চোখে পড়া ওই ঘটনা সত্যিই ঘটেছে। অপয়া নারী, মরবার টিকিট পাননি। ৪ তলার সানশেডে পড়ে ছিলেন। হাসপাতালে জীবন বাঁচানো আর মরার মধ্যে দুলছেন। মরার স্বাধীনতাও তাকে বিধাতা দেন নাই। জীবন এক কুৎসিত সময়ের অপর পিঠ।]
#suicide #urbansociety #urbanlife #lifeinmetro #classstatus #classconflict #classdiscrimination #poverty #middleclasslife #nakedlife #thuglife #nationaldestruction #destructivenation #socialdestruction #socialdeviation