আজ অনেকটা জোর করেই লিখতে বসলাম। বিশেষ একটি তফসীল রক্ষা করবার তাড়ায় নিজের সাথে নিজের এই জবরদস্তি।
লেখালিখি আসলে এমন একটি অভ্যাস বা কাজ, যা লেখকের ইচ্ছা কিংবা পাঠকের ফরমায়েশের ওপর নির্ভর করে না। মানে, লেখক চাইলেও ইচ্ছেমতো লিখতে পারেন না। মন চাইল, লিখতে বসলেন আর যে কোনো বিষয়ে লিখে ফেললেন-বিশেষত কবিতা ও গল্প-সেটা প্রায় অসম্ভব। তবে বড় মাপের সাহিত্যিক ও লেখকদের কথা জানি না। আমি বলছি আমার মতো পাতি ও হাউশের লিখিয়েদের কথা।
অথচ লেখাটা আমারও নেশার মতো। নিয়মিত লিখতে না বসতে পারলে বুকে চাপ অনুভূত হয়। সেই চাপ উপচানো রক্তচাপের মতো এদিক সেদিক দিয়ে নির্গত হতে প্রয়াস চালায়। ওদিকে, ভারতবর্ষের এক ঊষর গ্রামে বসবাসরত আমার একজন অগ্রজ সুহৃদ (তিনি দাবী করেন তিনি আমার কবিতার ভক্ত) এসব এলেবেলে দেখে গরম গরম বার্তা পাঠান, “বলি, হচ্ছেটা কী? কবিতা কোথায়?” মধুর এই চাপ।
তবুও, এই নেশা আমার হাতে নেই। লেখা যখন আসে, যখন একটা লেখার আভাস মাথার মধ্যে এসে যায়, লেখারা মগজের ধূসর অলিগলিতে কিলবিল করে জমতে থাকে, তখনই লিখতে পারি। তার আগে না। চাইলেও লেখা আসে না।
এই টানাপোড়েনের মধ্যেই একদিন সহধর্মীনিকে নিয়ে কোথাও হতে ফিরছিলাম। মিরপুর ১০ নম্বর চক্করে একজন মধ্যবয়স্কা নারী আমাদের যান্ত্রিক শকটের ধুলো জমা কাঁচে টোকা দিলেন। চোখ তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাই-“অ বাই, আমারে একডা পাউরুডি কিন্না দিবেন?” আমি আমার সহযাত্রী নিটোলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাই। সেই দৃষ্টিতে অনুমতি প্রার্থনা থাকে, নাকি যথার্থতা যাঁচাইয়ে সহায়তার প্রার্থনা থাকে-তা নিজেই বুঝি না। এমনিতে, সামান্য মৌসুমী ফুলকপি-সেটা ’দেশী’ নাকি ‘হাইবিরিঠ’-সেটাই আমি আজও ধরতে পারি না। এহেন অকর্মা আমাকে নিটোল পিটিয়ে পাটিয়ে চালায়। তার সাহায্য আমি নিতে বাধ্য। আমি চোখ বুজে তার বিবেচনাতে ভরসা করি।
কিনে দেবার আগেই অবশ্য শকট জানজট পেরোতে শুরু করল। ’পাউরুটি কিনে’ দেবার সুযোগ যে নেই-সেটা তিনিও জানেন। এটি আসলে একটি ইঙ্গিত, মানে, ৫০টি টাকা দাও। ওই চক্করটাতে ওই ভদ্রমহিলা সারাদিনে যখনই সাক্ষাত হয়, একই রোদন সব শকট যাত্রীর কাছেই করেন। দিন বা রাত বিরাম নেই। তাত্বিকভাবে সবাই যদি শকট হতে নেমে তাকে পাউরুটি কিনে দিতে শুরু করতেন, ঢাকার সব পাউরুটি তার কোচরে জমা হত।
আমরা শহুরে উদীয়মান বাবুরা ভিক্ষুক দেখলে নাক সিঁটকাই। “কাজ করে খেতে পারে না?”-এই আপ্তবাক্য আওড়াই। যদিও ঠিক কী কাজ তাদের পক্ষে করা সম্ভব, অথবা রাষ্ট্র তাদের জন্য কী মহান কাজ পয়দা করে রেখেছে-তা আমরা কেউ জানি না। আসলে দৃশ্যমান ও মানসিক পীড়নের দায় এড়ানোর এক মোক্ষম ’Alibi’ হল ওই শব্দগুচ্ছ, “কাম কইরা খাইবার পারো না?”
বিষয়টা তেমন কিছু নয়। তবে সেটা নিয়ে লিখতে বসবার এবং আমার লেখার খরাতে জল সিঞ্চনের সূচনা হবার কারন তখন ঘটল, যখন একই রকম কয়েকটি ঘটনা পরপর কয়েকদিন একাদিক্রমে ঘটল। বাসার কাছে ‘হাপিশ হোটেল’ এর সামনে চা খেতে গিয়েছি আমরা মিয়া-বিবি। বোরকা পরিহিত জনৈকা নারী (কে জানে হয়তো পুরুষও হতে পারে) আরোপিত করুণ সুরে নিবেদন করলেন, ”বাবাজি, আমি হাপানির রুগী। একডা Inhaler কিন্না দিবেন?” (কিনে দিয়েছি কিনা-সেই প্রশ্নের উত্তর সঙ্গত কারণে দেব না।) একটু বাদেই আরেকজন এলেন। ”ও বাজান, আমারে মাছ দিয়া এক পেলেড বাত খাওয়াইবেন নি?” (পাশেই মিরপুরের বিখ্যাত হাপিশ হোডেল।] তারই বাদে আরেকজন, যার হাত ধরে আছে বাচ্চা একটি ছেলে, পরনে লম্বা জুব্বা, মাথায় টুপি; “অ বাই, পোলাডার মাদ্রাছার ভর্তি ফী ডা দিয়া দিবেন?”
পরের দিন আরেকজনকে পেলাম, যিনি দাবী করছেন, “কিডনি রুগী। ডায়ালায়সিস করার পয়সাডা দিবেন?” (তার হাতে তিনশো বছরের পুরোনো সম্রাট তুতেনখামেন কিংবা সম্রাজ্ঞী নেফারটিটির ‘মুতের রোগ’ এর Prescription ।
একই পন্থায় যখন একে একে মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই “মেয়ের বিয়ে”, “বাড়ি যাবার বাসভাড়া”, “এক কেজি চাউল”, “বাবার শ্রাদ্ধ”-এমন অনেকগুলো ঘটনা একাদিক্রমে সামনে পড়ল, তখন একটু নড়ে বসতে হল। সবশেষ, এই তালিকায় যুক্ত হলেন একজন রিক্সাচালক। কলেজগেটে, রাতে ফেরার সময়ে নিটোলের ওষুধ কিনতে থেমেছি। ওষুধের দোকান হতে ফিরছি। আমাদের বাহক শকটটিতে উঠব। সামনেই একজন রিক্সাচালক দাড়ানো ছিলেন। মাত্রই তাকে যাত্রী নামাতে দেখলাম। তিনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন।
তার প্রথম প্রশ্নটি হল, ”বস, আপনে কি এই ঘাঁড়ির মালিক?” [আমি সামান্য নড়ে উঠলাম। খাইছে, Tax গোয়েন্দা নাকি নীলা জাহাঙ্গিরের চ্যালা-কে জানে?]-”এই প্রশ্ন করছেন কেন?”
”না, মানে, আপনে কি এই ঘাঁড়ির মালিক স্যার?”-”না, আমি মালিক না।”
”না, মানে, আল্লায় আপনেরে ঘাঁড়ির মালিক বানাইছে। (অথচ আমাকে বিধাতা তিন চাকার রিক্সার মালিকও বানান নাই।) আমারে যদি একডু সাহাইয্য করতেন?”
রিক্সাচালক এমনিতে সবসময়ে এই approachটি করেন না। যাকে তাকেও করেন না। তক্কে তক্কে থাকেন। যখনই কাউকে মনে ধরে, কাউকে আলগা পয়সাওলা মনে হয়, তাকে Approach করেন। Target কে আমড়াগাছি করেন। তাকে ঈশ্বর কতভাবে করুণা করেছেন-সেই ফিরিস্তি দেন। অতঃপর একটি কৌশলি গল্প বলেন-যেটিকে মানাও কঠিন, আবার ঝেড়ে ফেলে দেয়াও সহজ না। যদি কিছু বাড়তি কামিয়ে নেয়া যায়। কারন, মানুষ বুঝে গেছে, এই ইবলিশ জামানাতেও, খোদ নীলা জাহাঙ্গীরের মনেও সামান্য দয়ামায়া চৈত্রের শুকনো ডোবার ভেজা কাদার মতো বিরাজমান আছে। আমাদের সবারই পাপের ঘড়া বেশ পরিপূর্ণ। তায় আবার আজন্ম লালিত Prejucided মনে পাপবোধ ও পাপের পোড়ানি এখনও কিঞ্চিত অবশিষ্ট আছে। তাকে জায়গামতো Hit করতে পারলেই ATM যন্ত্ররের ঘরররররররররর শব্দ।
পরপর ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো আমাকে ভাবতে বসালো। এই approach গুলো যারা করছেন, তারা কেমন মানুষ, তাদের মনে কী আছে-সেটা জানা সত্যিই আমার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু, মানুষের Sixth Sense নামে একটা জিনিস নাকি আছে। সেই জিনিসটি আমাদের অন্তত ভাবনার খোরাকতো নিশ্চয়ই দিতে পারে। একটা ইঙ্গিত তো নিশ্চয়ই দিতে সক্ষম। যারা মাত্র কিছুদিন আগেও সরাসরি ১ টাকা, ২ টাকা, ৫ টাকা সরাসরি ভিক্ষা চাইতেন, তাদের একটি বিরাট অংশ হঠাৎ করে সুনির্দিষ্ট খাত ও ওজর উল্লেখ করে এই approach গুলোর বদৌলতে কার্যত বড় অংকের দান বা ভিক্ষা চাওয়ার যে সংস্কৃতি (বা আসলে Treacks) আবিষ্কার করেছেন, সেটিকে কি নিখাঁদ মানবিকতা ও কোমল দৃষ্টিতে অবশ্যই দেখা সম্ভব? নাকি বিষয়টাতে খটকা লাগাটাই স্বাভাবিক?
বিশ্বাস না হলে আপনি ১ টাকা বা ২ টাকার মুদ্রা দিয়ে ভিক্ষা দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখুন। ভিক্ষুকদেরও এখন ঢাকা শহরে না হোক, মফস্বলে এক খানা ’সেমিপাকা’ বাড়ি, কয়েক লাখের ব্যাংক ব্যালেন্স করার দূরহ স্বপ্ন খুবই common । থাকতেই পারে। কুঁজোর কি চিৎ হয়ে শোবার শখ হতে মানা? এমনিতে মাঝেসাঝে ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে, ভিক্ষুক ও তাদের ভিক্ষার কৌশল নিয়ে নানা প্রতারনার খবর আমরা পাই। শুনে নব্য শহুরে বড়লোক বাবু (আসলে চরম নিম্নমধ্যবিত্ত) আমরা হাসি ঠাট্টা করি, ওদেরকে “শালা ছোটলোক” বলে গালিগালাজও করি। কিন্তু, সেটা যখন মাত্রায় এত বাড়ে, তখন তা আমার মতো উজিরে খামোখাদের নিশ্চয়ই সামান্য ভাবায়।
বিষয়টা কি একরকম অনুভূতির সাথে খেলা হচ্ছে? ওঁরা কি আমাদের Sentiment কে কেনাবেঁচা করার চেষ্টা করছে? বড় মানুষদের কথায়, এটা কি Emotional blackmailing? ওঁরা কি তাহলে আমাদের কোমল Religious belief কে সুকৌশলে exploit করছে? ফার্মগেট বা কমলাপুরের ওভারব্রীজের প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে জনৈক বোরকাবৃত নারী যদি রেহেলে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ রেখে ঝুঁকে ঝুঁকে পাঠ করতে থাকেন, আমার কি আবেগে গলে যাওয়া উচিত? নাকি দ্বিতীয় ভাবনার অবকাশ আছে?
যুগ যুগ ধরে আমাদের মনে ও স্মৃতিতে সঞ্চিত নানা তথ্য, সত্য, জ্ঞান, বিশ্বাস, Taboo, Prejudice, মীথ আমাদের চিন্তাশক্তিকে চালিত করে, প্রভাবিত করে। এমনই একটি মীথ অথবা belief এর নাম Sentiment । এই Sentiment আমাদের মনের কোণে Soft corner গড়ে রাখে। মানুষ হিসেবে এই Soft corner ও Sentiment আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই Sentiment আর মানবিক মনুষ্যত্ববোধ আমাদেরকে মানুষ হিসেবে, মানুষের পরম শুভাকাঙ্খী হিসেবে চালিত হবার মন্ত্রণা দেয়। কিন্তু, যুগটি যেহেতু অন্যরকম, সে কারনে আমাদেরকে একটি Second thought দিতে বাধ্য হতে হয়। না, একজন প্রতারক বা কৌশলী ভিক্ষুক আমাদের পকেট হতে ১০-২০-৫০ টাকা ভাওতা দিয়ে নিয়ে গেলে আমরা কেউ গরীব হয়ে যাব না। সেটা আমরা জানি। এর চেয়ে ঢেঁর বেশি টাকা প্রতিদিন আমরা সামান্য ধুম্রশলাকা পোড়াতেই অপচয় করে থাকি। কিন্তু, তাহলে ওই সামান্য ১০-২০ টাকার অনুরোধ ও তার ধরন-প্রেক্ষাপট নিয়ে আমরা এত Serious কেন?
আমার কাছে মনে হয়, বিষয়টির সাথে আমাদের অহংবোধ ও প্রতারিত হবার অপমানবাধ জড়িত। আমাদের থেকে কেউ ঠকিয়ে ১ টাকা নিয়ে গেলে অর্থদন্ড বিচারে যতটা না আমরা আহত হই, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি আহতবোধ করি, এই ভেবে, যে, আমার ওপরে বাটপারি করার মতো কেরেদ্দার তাহলে কেউ আছে আর সে আমাকে জোচ্চুরীতে হারিয়েছে। তদুপরি, আমাদের মনের ভেতরে ডুব মেরে থাকা এবং এত এত পরিবর্তনের পরেও বেঁচে থাকা Sentiment ও Soft corner এর এহেন অপব্যবহার আমাদেরকে আহত করে। মানবের ইতিহাস বলে, মানুষ তার অহম ও অনুভূতি আহত হলে সবথেকে বেশি আহত ও ক্রুদ্ধ হয়। এই আহতবোধ ও প্রতারিত হবার প্রতিহিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া অবচেতনেই আমাদেরকে গুটিয়ে যেতে প্ররোচিত করে। ফলে, সত্যিকারের প্রার্থী ও অসহায়দের জন্য পৃথিবীটা দিনকে দিন আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃত হক্কদাররাও অধিকার হারাচ্ছেন।
আচ্ছা, Sentiment এর যথার্থ বাংলা কী? অনুভূতি নাকি? [আমি এই লেখার মাধ্যমে Judgemental হতে চাইনি। পাঠকদেরও সেটা হবার মন্ত্রণা দিতে চাইনি। ভিক্ষুক বা সাহায্যপ্রার্থীকে ১০ টাকা দান করবার জন্য এত এত বিবেচনা করার আদৌ দরকার আছে, কি নেই-সেই Advocacy দিতেও আমার প্রবৃত্তি নেই। আমি শুধু আমাদের Sentiment কে exploit করবার নানা বাহানা নিয়ে চিন্তিত। এমনিতে বান্ধব, পরিবার, সমাজ মায় রাষ্ট্র-প্রতিনিয়তই আমাদের Sentiment নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা খেলছে। তার ওপরে, আঘাত পেতে পেতে, প্রতারিত হতে হতে হারাতে বসা সামান্য Sentiment ও মানবিক দৃষ্টিকেও যদি এভাবে ঘাঁ মেরে মেরে মারবার উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন সামান্য সাবধানী তো হতেই হয়। কারন, অনুভূতি আর মানবিক মনটা মরে গেলে আমরা আর কীসে মানুষ রইব?]
#classstatus #classconflict #classdiscrimination #poverty #middleclasslife #nakedlife #thuglife #mugging #urbanslaves #streetbegger #beggingasprofession