আমার অনেক লেখায়, কথায় প্রায়ই আমি অনেককে বলে থাকি, “ভাই, আপনি যদি স্বর্গেও থাকেন, ভাল থাকেন, তারপরও নিয়মিত বিরতিতে আপনার অন্তত স্বর্গের স্তর বদলের চেষ্টাটা জারি রাখা উচিত।“
এই কথা শুনে অনেকেই বলেন, “কেন ভাই, ভাল বেতন পেলে, ভাল থাকলে ইতি উতি তাকানোর দরকার কী? একটা ভাল যায়গায় থিতু হয়ে সেখানেই জীবন শেষ করলে ক্ষতি কী?”
ভাইও অর ব্যাহেন, সম্প্রতি একখানা স্বর্গে ওভারনাইট ২০ জন টপ বিজনেস লিডার আর আরেকখান ভূস্বর্গে ৩০০ জন পশ বিজনেস ওয়ার্কারকে কলমের এক খোঁচায় পথে নামিয়ে দেবার ঘটনা দেখেও ওই খাহেশ জারি আছে? (উইদ অল রেসপেক্ট টু এমপ্লয়ারস অ্যান্ড দেয়ার কনশিয়েন্স, মজা করে বললেও, তারা যদি আইন মেনে কাজটা করে থাকেন, নাথিং রং লিগ্যালী। আমরা কথা বলছি হিউম্যানয়েড সাইড অব ল।)
গদি আঁটা, সোনায় মোড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত খাঁচা ভাল। তবে সেই খাঁচায় থাকতে থাকতে উড়না ভুল যানা-ভাল না।
নতুন চাকরীতে জয়েন করবার আগে বা ওই প্রতিষ্ঠানে জয়েন করবেন কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেবার আগে অনেকেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। আগের জায়গাতে থেকে যাবেন কিনা অথবা অফার পাওয়া প্রতিষ্ঠানটিতে জয়েন করা ঠিক হবে কিনা-সেই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। আপনার সিদ্ধান্তটি নিতে সাহায্য করবে কতগুলো কমপারেটিভ এনালিসিস। দেখুন তো আপনার সাহায্য দরকার কিনা:-
১.আপনি কি নিশ্চিৎ যে, আপনার বর্তমান প্রতিষ্ঠানটিকে সত্যিই ছাড়তে আপনি স্থিরচিত্ত কিনা অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ছাড়বার মতো সত্যিই যথেষ্ট কারন আপনার আছে কিনা। আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নেবেন না। একটি জব তখনি ছাড়বেন যখন সেটা ছাড়বার পেছনে আপনার ক্যারিয়ারের স্বার্থ থাকবে। আপনি যদি কোনো গ্রিভ্যান্সের কারনে নতুন জবে যেতে চান, তবে একবার হলেও নিরপেক্ষভাবে ভেবে নিন, সত্যিই ওই গ্রিভ্যান্স ক্ষমার অযোগ্য কিনা।
২.নতুন প্রতিষ্ঠানটিতে গেলে আপনার বর্তমান জবটির তুলনায় কোন কোন ফ্যাসিলিটিতে কেমন পরিবর্তন হবে এবং তার কতগুলো আপনার জন্য পজেটিভ বা কত পার্সেন্ট পজিটিভ-সেটা ভাবুন। প্রয়োজনে একটি চেকলিষ্ট করে নিন।
৩.নতুন জবের কি কি ফ্যাসিলিটি ক্রসম্যাচ করবেন দেখুন: বেতন, বোনাস (কতবার ও কত হারে), মোবাইল এলাউন্স, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পদ্ধতি ও হার, প্রমোশনের টাইমলাইন, অফিস আওয়ার, লাঞ্চ ফ্যাসিলিটি, ট্রান্সপোর্ট ফ্যাসিলিটি কীরকম, লিখিত এপয়েন্টমেনট লেটার ও জব কন্ডিশন, টার্মিনেশন পলিসি, সার্ভিস বেনেফিট, ছুটির সংখ্যা ও দিন, সিপিএফ, মেডিক্যাল ইন্সুর্যান্স, জব ডেসক্রিপশন-ইত্যাদি।
৪.যে বসের আন্ডারে কাজ করবেন তিনি কেমন বস সেটা জানার চেষ্টা করুন। বেতনের অঙ্কে বিশাল রেইজ হলেও বাজে বসের সাথে কাজ করার বিরম্বনা ওটাকে জিরোতে পরিনত করতে পারে।
৫.কোম্পানীর সার্বিক কর্মপরিবেশ ও অফিস কালচার কেমন সেটা বিবেচনায় রাখুন।
৬.কোম্পানীর আর্থিক সক্ষমতা এবং গ্রোথ রেট পারলে খোঁজ নিন। নড়বড়ে আর্থিক অবস্থার কোম্পানীতে ১ লাখ টাকার চেয়ে বড় কোম্পানীতে ৮০ হাজার স্যালারী বেশি ভালো।
৭.যদি একদম পারিবারিক ব্যবসায়ী কোম্পানী হয় তবে পারলে টপ ম্যানেজমেন্টের প্যাটার্ন সম্পর্কে জেনে নিন। হতে পারে আপনি তাদের সাথে একদমই ম্যাচ করতে না পেরে নতুন দারুন চাকরীও ছাড়তে বাধ্য হতে পারেন।
৮.নতুন জবে আপনার স্যালারী কত পার্সেন্ট বাড়বে সেটা ভেবে নেবেন। ৩০-৪০% হল এভারেজ রেইজ রেট। পাশাপাশি স্যালারীর সাথে আপনি আরো যেসব ফ্রিঞ্জ বেনেফিট পাচ্ছেন সেগুলোর আর্থিক মূল্যের বিপরীতে ওখানে যা যা পাবেন তার কমপারেটিভ এনালিসিস করুন।
৯.নিয়মিত স্যালারী পেমেন্ট হয় কিনা জেনে নিন।
১০.কোন পজিশনে বর্তমানে আছেন আর ওখানে কোন পজিশনে যাবেন সেটা ভাবুন। শুধু যে ইকুয়াল বা উপরের পজিশনে যাওয়াটাই হতে হবে তা নয়। প্রতিষ্ঠানের ব্রান্ড ভ্যালুর উপরে ভিত্তি করে পজিশনে বা র্যাংকে আপ-ডাউন নিয়ে ভাবতে পারেন।
১১.নতুন কর্মস্থলে গেলে সবগুলো প্রাপ্য বিষয়ের সাথে বর্তমানের পার্থক্যটা কতটা বেশি সেটা অবশ্যই বিবেচনায় আনবেন। মনে রাখবেন, একটি সেটেলড জবের স্ট্যাবিলিটি কস্ট নামে একটা বিষয় আছে যেটা টাকার অঙ্কে কনভার্ট করলে সেটার মূল্য কম না। নতুন জবে নতুন বসের সাথে নতুন পরিবেশে নতুন চ্যালেঞ্জে মানিয়ে নেবার বিপরীতে বর্তমান জবে ওগুলোতে দারুন কমফোর্টে থাকার বা হাতের তালুর মতো চেনা থাকার প্রাপ্তিটুকুরও মূল্য আছে। তার বিপরীতে আপনি কতটা বেশি পাবেন নতুন স্থানে সেটা ভেবে নেবেন। আর এই সবকিছুই নির্ভর করবে আপনার কমপারেটিভ চয়েসের ওপর। এনালিসিস করুন, নিরপেক্ষভাবে লজিক নির্ধারন করুন, আর তারপর যেটি সিদ্ধান্ত নেবেন সেটিতে স্থির হোন।
এতটুকু করতে পারেন, আপনার এনালিসিস নিয়ে একজন ক্যারিয়ার এক্সপার্ট বা সিনিয়র এইচআর প্রোফেশনালের পরামর্শ নিন। তবে যাই করবেন, ভেবে করবেন। করে ভাববেন না। প্রতিভার আঁতুড় ঘর নামে যেমন কিছু আছে,
তেমনি, রয়েছে প্রতিভার কসাইখানা, প্রতিভার ডাম্পইয়ার্ড, প্রতিভার লাশকাটা ঘর, প্রতিভার মর্গ। যেখানে প্রতিভার মরণ হয়, প্রতিভাকে ফেলে রেখে পঁচানো হয়, প্রতিভাকে ব্যবচ্ছেদ করা হয়, প্রতিভাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়।
আরও আছে প্রতিভার ব্ল্যাকহোল। যেটা ব্যক্তির প্রতিভাকে, সৃষ্টিশীলতাকে, সম্ভাবনাকে শুষে, গিলে ভ্যানিশ করে দেয়। ব্যক্তি, টিম, প্রতিষ্ঠান-যার সাথেই কাজ করতে মনস্থ করুন, আগে একটু দেখে নিন, তিনি, বা তারা প্রতিভার আঁতুড় ঘর, নাকি মর্গ। অন্যথায়, প্রথমে কাঁচা টাকা আর শো-ম্যান-শীপ পেয়ে মজা লাগলেও, বেশিদিন সেটা এনজয় করতে পারবেন না। আর করলেও, আপনার সামুরাই জং ধরে অকেজো হবে। পাগলের সাথে গলাগলি দোস্তি করে চললে ‘মিডা’র রসালো ভাগ পেয়ে মজা লাগলেও, এই পাগলের পাগলামি আর ছাগলামিতে জীবনও যাবার সুযোগ আছে। ভাল করে ভেবে দেখুন।
টাকা জীবনের অবজেকটিভ নয়, মিডিয়াম মাত্র।
আপনার জীবনে কোনটা অবজেকটিভ, কোনটা পারপাস, আর, কোনটা মিডিয়াম-ভাল করে বুঝে নিন।
আমরা প্রায়শই অবজেকটিভ আর মিডিয়ামকে গুলিয়ে ফেলি।
যেমন টাকা। টাকা কখনোই জীবনের অবজেকটিভ হতে পারে না। টাকা কেবলই একটি মিডিয়াম। সচ্ছলতা হল টাকা নামক মিডিয়ামের মধ্য দিয়ে কাম্য পারপাস।
আর সচ্ছলতা নামক পারপাস সার্ভ হবার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে চাই ডিগনিটি, কমফোর্ট ও সেফটি নামক অবজেকটিভ। তাই, কিছুর পেছনে পড়বার আগে একটু ভেবে নিলে ভাল, যে, সেটা কি আমার মিডিয়াম, না অবজেকটিভ, নাকি পারপাস।
#JobSwitching #Dilemma #ConfusionOfJobswitching #Migration #Shifting #Jumping