Skip to content

অ্যালগরিদমের চক্করে বাইনারি জীবন

  • by

১. আমরা বিক্রী হচ্ছি, সংখ্যায়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভাজিত হয়ে:

আপনার অজান্তেই যেভাবে বিক্রী হয়ে যাচ্ছেন আপনি, যেভাবে আপনি পরিণত হচ্ছেন স্রেফ একটি সংখ্যা ও ফিগারে-সেটা জানলে শিউরে না উঠলেও একটু চিন্তায় নিশ্চয়ই পড়বেন।

বিক্রী হচ্ছে আপনার তথ্য। আপনার নিজেকে যতটা নিজে না জানেন, তার চেয়ে বেশি জানেন অন্যরা। সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইন ফোন, গুগলের হাত ধরে আপনার ব্যক্তিগত সব তথ্য, ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত জীবন-সবই ট্রান্সলেটেড, শেয়ারড, কপিড হচ্ছে সবখানে। এমনকি, আপনার প্রিয় আইসক্রীম কোনটা, আপনি পরকীয়া করছেন কিনা-সেই তথ্যও খুব প্যারালালি মেইনটেইন হচ্ছে। এবং, সবচেয়ে ভয়ের কথা, এই তথ্য কেনাবেঁচা এখন অনেক জায়ান্টের বিজনেসের সবচেয়ে বড় পণ্য।

গুগল কীভাবে আজ হতে কিছু বছর পরে আমাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নেবে-তা নিয়ে একটি খুব মজার গল্প অনলাইনে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে একটি পিজ্জা অর্ডার করাকে কেন্দ্র করে গুগল অ্যাসিসট্যন্ট কাস্টমারকে ডমিনেট করে।

কয়েকদিন আগে আমাদের টীমমেটদের সাথে মাসিক এক VC তে বলছিলাম, খুব শীগগীরই একটি super sophisticated সময় আসছে, যখন, আমাদের, মনে মনে করা ইচ্ছেগুলোও নিয়ন্ত্রিত হবে গুগল কিংবা ফেসবুকের অঙ্গুলি হেলনে। মনের গভীরে জাগা চিন্তার ধারাটিও রিড করে প্রকাশ করে দেবে গুগল।

বিশ্বাস না হলে খুব ক্ষুদ্র একটি যোগসূত্র দেখাই। মোবাইল বা ল্যাপটপের স্ক্রীনে আপনি কী করেন, কী দেখেন, কোন পোস্টে কতটা পজ দেন, কোনটা সময় নিয়ে দেখেন, কোনটা খোঁজেন, কোনটাতে স্ক্রল ব্যাক করেন, কোন জিনিস হাইড করে দেন, কোনটাতে আপনর চোখ কীভাবে আটকে বা দেখে-এই সবকিছুই রেকর্ড, এনালাইজ এবং সেল হচ্ছে।

একবার আমার পার্টনারের সাথে একটি নতুন ওয়ালেটের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা হচ্ছিল।
সেই হতে শুরু, অন্তত ৩ দিন, স্ক্রীনে শুধু চামড়ার প্রোডাক্ট আর মানিব্যাগের পোস্টই ভিজিবল বা অফারড। আমি একে নেহাতই কাকতাল মানতে আর পারছি না।

এখনই ফেসবুক আমাকে তার পছন্দ অনুযায়ী ফিড দেখায়। আমি কী দেখতে পাব-তা ঠিক করে দিচ্ছে ফেসবুক নিজেই।

একবার শুধু গুগলে ট্রিমারের ব্র্যান্ড দেখেছিলাম। তার ৩০ দিন তক ফেসবুকের ফিডে কেবলই ট্রিমারের পোস্ট ও প্রমো।

বিষয়টি মিথ্যে নয়, সত্যি। মাত্রই সেদিন জানলাম, ফেসবুক আমার স্ক্রীনের স্ক্রল রেকর্ড ও এনালাইজ করতে পারে। যদিও, গোপনীয়তার মতো বিষয় কিছু নেই, তবুও, আমার তথ্য আমি কেন অন্যকে চুরি করতে দেব?

যদিও আমার সাথে ফেসবুক ও তার অ্যালগরিদম বেশ বেড়াছেড়া করে ফেলে। জানি না কেন। একটু বলি।
ফেসবুকের অ্যালগরিদম আমাকে বাঁশের কেল্লা পেইজের ফিড মূলোর মতো দুলিয়ে দুলিয়ে অফার করে।
অথচ, বাঁশের কেল্লা অথবা বদের কেল্লা পেইজ, অথবা উঁহাদের পশ্চাতে থাকা বীরপুঙ্গবদের আমি মনুষ্য মলের চেয়েও বেশি ঘেন্না করি।

তাহলে ফেসবুক ঠিক কোন সূত্র ও হিসেব ধরে ধরে আমাকে বদের কেল্লা বা আরও এরকম কুৎসিত ফিডগুলো পরিবেশন করে? আমি যার হেটার, আমার ফেসবুক অ্যাকটিভিটিও যেই হেটরেডের ব্যাকআপ সাপোর্টার, ফেসবুক আমাকে সেটার সম্ভাব্য কাস্টমার ঠাউরায় কীভাবে?

ওদিকে, ২০১৬ সালে ফেসবুক আমার যেই পোস্ট এপ্রুভ করেছে, ২০২৪ সালে সেটা রিপোস্ট করলে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ব্রেকেজের ওয়ার্নিং আসে। পোস্ট রিমূভ করে নোটিস দেয়।

ফেসবুকে ঘুরে বেড়ায় লাখ লাখ গারবেজ, ফেইক সব গল্প, ছবি, ফালতু অথবা নোংরা সব বস্তুকণা। কোনো বাধা দেখি না। অথচ, আমি সামান্য সারকাজম পোস্ট করলেও সে উল্টো বোঝে, বিভ্রান্ত হয়, তেড়ে আসে।
তবে আমার অভিজ্ঞতাকে পাশে সরিয়ে রেখে, আমার আশংকা আবারও বলছি, খুব দ্রূতই একটা সময় হয়তো আসছে, যখন, ফেসবুকই বলে দেবে, “তোমার ক্ষুধা লাগার সময় হয়েছে।” “তোমার বাথরুম পাওয়া উচিত এখন।”

এই ডিজিটাল ব্ল্যাকহোল সত্যিই ভয়ঙ্কর। সত্যিই।

অ্যালগরিদমের বাহানা কেবল সার্চ এঞ্জিনই না, সোশ্যাল মিডিয়াও আপনাকে দেয়। সে ঠিক করে দেয়, আপনি কী দেখবেন। আপনি হয়তো ভাবেন, আমি আজ ফেসবুকে এই এই দেখেছি। আসলে অন্য পিঠটা দেখতে পেলে বুঝতেন, যে, ফেসবুক বা লিংকডইন তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, অ্যালগরিদম, কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ও গোপন মিশন ফলো করে ঠিক করে, আপনাকে কী দেখানো হবে, আর কী দেখতে দেয়া হবে না। এতে করে, আপনি ধীরে ধীরে একটি মেশিন বা বট বা সাইট বা পোর্টাল বা মতবাদ কিংবা বডির বায়াসড চিন্তার ক্রীড়ানকে পরিণত হন। আপনি আর আপনার মানুষটা থাকেন না, আপনি পরিণত হন একজন মডিফায়েড হিউম্যানে। মডিফায়েড বাই থট মেশিন অ্যান্ড এশটাবলিশমেন্ট।

ভেবে দেখুন তো, জন্ম হতে যদি কেউ দেখত, যে, গরু গাছে ওঠে, সেও কি বিশ্বাস করতে শুরু করত না, যে, গরু আসলেই গাছে চড়তে পারে? মানুষ তার কগনিটিভ বায়াস ও কনফারমেশন বায়াসের কাছে বন্দী। মেশিন ও মেশিন বুদ্ধিমত্তার ঘেরাটোঁপে বন্দী মানুষ যদি মেশিন কর্তৃকও বায়াসের শিকার হয়, তাহলে তার নিকট হতে রিয়েল মানুষটাকে আর দেখা যাবে না। শুধু দেখা যাবে ফিলোসফিক্যালি মডিফায়েড ব্রেইন ওয়াশড বা ব্রেইন চাইলড অব বটস।

ক. সোশ্যাল মিডিয়া: অ্যালগরিদম যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আপনার অনলাইন জীবন: https://www.bbc.com/bengali/news-58877493;

খ. ফেসবুক আমাদের নিয়ে যেভাবে ব্যবসা করে: https://youtu.be/V7nVS7bX1JM;

২. সংখ্যাতত্বের গোলকধাঁধাঁ:

অ্যালগরিদম ও বাইনারি-দুটো টার্ম নিয়ে একটু পড়াশোনা করতে হবে ভ্রাতা ও ভগ্নি।

বঙ্গফেসবুকীয় আকাশে প্রায়ই অনেককে দেখবেন, তার হাজার হাজার ’ফেসন্ধু’ (ফেসবুক বন্ধু) কেন তার পোস্টে রেসপন্স/রিঅ্যাক্ট করেন না-সেই ক্ষেদে রীতিমতো শিডিউল দিয়ে কাতারে কাতারে ফেসন্ধুকে আনফ্রেন্ড করার উৎসব করেন।

একই ক্ষেদ আমাদের লিংকডইনেও হয়। কেন রেসপন্স হয় না, কেন রিঅ্যাকশন দেয় না-এই ক্ষোভে কানেকশন লিস্ট রিশাফল হয়। আমি ওনাকে, তেনাকে এত রেসপন্স দিই, উনি তো কই কখনো আমাকে দিলেন না-এই গ্রীভ্যান্সও হয় আমাদের।

গ্রীভ্যান্স খুবই ভ্যালিড।

তবে, কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আপনি আপনার ৫ হাজার ফেসন্ধু, ৩০ হাজার লিংকানেকশন, আর দুই মাধ্যমের লাখ খানিক ফলোয়ারদের কতজনকে রেসপন্স দিতে পারেন? উত্তর সহজ-খুবই খুবই কম। খুব স্বাভাবিকভাবেই খুবই কম।

তদুপরি, অ্যালগরিদম নামে একটা রূঢ় বিষয় আছে দুই মাধ্যমে।

আপনি কিছু পোস্ট করলে সেটি কার ও কতজনের নজরে কখন কীভাবে কতটা দেয়া হবে-উভয় প্ল্যাটফরম সেটি নিজস্ব স্বার্থ ও নিয়মে নির্ধারন করেন। আবার, আমিও কখন, কার, কোন, কতটা দেখব-সেটা আমার ইচ্ছেতে হবে না। ওটা নিয়ন্ত্রিত। তাহলে বুঝে নিন, আপনার পোস্ট তার নজরে আসে কিনা-সেটা নিশ্চিত না। নজরে না এলে তিনি নিয়ম করে আপনার দেয়ালে গিয়ে লেখা/পোস্ট খুঁজে সেটাতে রেসপন্স দেবেন-এটা বোধহয় একটু বেশি বেশি আশা করা হয়ে যাবে।

সবচেয়ে বড় কথা হল, এই দুই খোলা আকাশে খোলা মন নিয়ে বিচরন করুন। এটা নিজের জানালা। নিজের মনের আনন্দে আকাশ দেখুন। নিজের আনন্দে এই খোলা আকাশে বিচরন করুন। সেটা করতে গিয়ে দুটো ভাল জিনিস দেখলে বা নিজের একটা রঙিন ঘুড়ি উড়ালে তাতেই আনন্দ পান। দর্শক নিয়ে এত ভাববেন না।

উন্মুক্ত ডিজিটাল মাধ্যমের কিছুই হারায় না। কুছ ভি আনসুনা, আনদেখা নেহি র‌্যাহতা।

৩. অংকের জীবন: ঐকিক নিয়মের সরলরৈখিক বর্গ

ছোটবেলায় অংকের স্যার আমাদের ঐকিক নিয়মের ফাঁকিটা বোঝাতে একটা গল্প বলতেন। ঐকিক নিয়ম অনুসারে,

যদি ৫০ জন লোকের একটি পুকুর কাটতে ১০ দিন লাগে।
তাহলে, ১০০ জন লোকের ওই পুকুর কাটতে লাগবে ৫ দিন।
তাহলে, ২০০ জন লোকের ওই পুকুর কাটতে লাগবে ২.৫ দিন।
তাহলে, ৪০০ জন লোকের ওই পুকুর কাটতে লাগবে ১.২৫ দিন।
তাহলে, ৮০০ জন লোকের ওই পুকুর কাটতে লাগবে ১৫ ঘন্টা।
তাহলে, ১৬০০ জন লোকের ওই পুকুর কাটতে লাগবে ৭.৫ ঘন্টা।
তাহলে, ৩২০০ জন লোকের ওই পুকুরটি কাটতে লাগবে ৩.৭৫ ঘন্টা।
তাহলে, ৬৪০০ জন লোকের ওই পুকুরটি কাটতে লাগবে ১.৮৭ ঘন্টা।
তাহলে, ১২৮০০ জন লোকের ওই পুকুরটি কাটতে লাগবে ০.৯ ঘন্টা।

এমনি করে, যদি ৫০ হাজার লোক লাগানো হয়, তাহলে তারা এসে ওই স্থানে দাড়ানো মাত্র অঙ্কের নিয়মে মুহূর্তে পুকুরটি কাটা হয়ে যাবে। কোনো সময়ই লাগার কথা না। কিন্তু, বাস্তবতা হল, ৫০ হাজার লোক ওখানে এলে, পুকুরটি কোনোদিনই কাটা হবে না। অংক আর বাস্তবতা ভিন্ন বিষয়।

অঙ্ক ও অংক দিয়ে বিজ্ঞানের জটিল আবিষ্কার করা যায়, সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়, তালকে তিল করে দেখানোও যায়। কিন্তু জীবন ও মানব সম্পর্কিত বিষয়কে স্রেফ অংক ও অঙ্ক দিয়ে বিচার করলে খুব ভুল হবে।

৪. নম্বরের মারপ্যাঁচ: জিডিপি, নাকি জিলিপী?

একজন বৃদ্ধ ইকনোমিক্সের প্রফেসর তাঁর মেধাবী ছাত্রকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন। রাস্তায় কিছুদূর গিয়ে তাঁরা একটা মরা ইঁদুর পড়ে থাকতে দেখলেন। প্রফেসর বললেন – শোনো, তুমি যদি এই মরা ইঁদুরটা খেয়ে ফেলতে পারো তাহলে তোমায় ৫০,০০০ টাকা দেব। ছাত্রটি দ্রুতই কস্ট বেনিফিট এনালিসিস করে ইঁদুরটা গপ করে খেয়ে ফেলল। মরা ইঁদুরের বিকট স্বাদ পেটে যেতেই ছাত্রের মনে প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছে হল৷

কিছুদূর গিয়ে আরেকটা মরা ইঁদুর দেখতে পেয়ে ছাত্র প্রফেসরকে বলল, স্যার আপনি যদি এই ইঁদুরটা খেয়ে ফেলতে পারেন, তাহলে আমিও আপনার ৫০,০০০ টাকা ফেরত দেব। প্রফেসরও সদ্য ৫০,০০০ টাকার ক্ষতিপূরণের আশায় ইঁদুরটা তুলে পেটে চালান করে দিলেন তক্ষুণি।

এরপর খানিকক্ষণ দুজনেই নিঃশব্দে পথ হাঁটছিলেন। নীরবতা ভেঙে ছাত্র প্রশ্ন করল – আচ্ছা স্যার, আপনার কি মনে হয়না, আমরা দুজন নেহাই বেহুদা বেকুবের মতো দুটো মরা ইঁদুর খেয়ে ফেললাম? স্মিতহাস্যে প্রফেসর উত্তর দিলেন-তা ঠিক, কিন্তু তুমি আর আমি মিলে মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে জিডিপিতে একলক্ষ টাকা যোগ করলাম, সেটা দেখলে না !

রাজনৈতিক অর্থনীতিতে গড় মাথাপিছু আয় নামে একটি সোনার পাথর বাটি থাকে। স্বৈরতান্ত্রীক ও অথরিটেটিভ রাজনৈতিক সরকারগুলো সেই মাথাপিছু আয়ের উল্লম্ফনকে তাদের কারিকুরির একটি নিদর্শন হিসেবে দেখাতে খুব হৃষ্ট অনুভব করে। ধরুন, আপনি বেকার, জব নেই। মাথাপিছু আয়ের অংকে, আপনার মাসিক আয় শুন্য টাকা, আর শিল্পমালিক চৌধুরী সাহেবের মাসিক আয় ৫ কোটি টাকা। এখন গড় মাথাপিছু আয়ের অংকের মারপ্যাঁচে আপনি ও চৌধুরী সাহেব-উভয়ের মাসে গড় আয় ২.৫ কোটি টাকা। অংক এভাবে বাবা ও ছেলের বয়স সমান করে দিতে পারে, বাঁদরকে তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ডগায় পৌছাতে পারে, ফুটো ট্যাংক ভরতে পারে, কিন্তু, সে আপনাকে সত্যি সত্যি দুটো টাকা এনে দিতে পারবে না।

৫. আবারও অঙ্ক, অংক ও নম্বরের চানক্য চাল:

অনেক আগে সম্ভবত ক্লাস সেভেন বা এইটে, সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা একটা গল্প পড়েছিলাম।

পন্ডিত মশাই। সেখানে পন্ডিত মশাই’র নানা কীর্তিকান্ডের পাশাপাশি একদম শেষে একটা অংশ ছিল।

সেখানে পন্ডিত মশাই তার প্রিয় ছাত্র শাখামৃগকে একটা অংক কষতে দেন। অংক কষার বয়ানটা অনেকটা এরকম ছিল:

”ওরে ও শাখামৃগ, মদনমোহন তোদের ভালই আক কষতে শেখায় শুনেছি। তা, একটা অঙ্ক কষ তো দেখি শাখামৃগ! সেদিন লাট সায়েবের স্কুল ভিজিটের সময় তার কুকুরটাকে দেখেছিলি না?

শাখামৃগ, মানে পন্ডিত মশায়ের প্রিয় ছাত্র বলে,” দেখেছি পন্ডিত মশায়। ওর তিনখানা পা ছিল। একখানা পা নেই।”

” তা, ধর, তিন ঠ্যাঙের কুকুরটার পেছনে লাটসাহেবের মাসিক খরচ ৭৫ টাকা হলে ঠ্যাঙ পিছু খরচ কত?”

”পন্ডিত মশাই, ঠ্যাঙ পিছু ২৫ টাকা।” শাখামৃগ দ্রুত উত্তর দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে।

“আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৮ জন।” পন্ডিত মশাই আবার শুরু করেন, ”এই পরিবারের জন্য মাসিক বেতন পাই মাত্র ২৫ টাকা। তাহলে আমার এই ৮জনের পরিবারটা লাট সায়েবের কুকুরের কয়টা ঠ্যাঙের সমান?”

অংক ও অঙ্কের জটিল হিসেবের মারপ্যাঁচে অন্যায্যতা, অসঙ্গতি, অপমান, বৈষম্য ও সামাজিক ভন্ডামীর দগদগে এক ঘাঁ সৈয়দ মুজতবা আলী তার সেই গল্পের পন্ডিত মশায়ের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিলেন।

৬. সামাজিক হতে কর্পোরেট অঙ্কের পাঠ

আমাদের মেথডিক ও মেকানাইজড সিস্টেম (বিশেষত ট্যালেন্ট অ্যাকুইজিশন প্রসেসের) আমাদের সব কাস্টমারদের একটা নম্বর হিসেবে প্রতিপন্ন করে। আমরাও নম্বর দেখে দেখে বিচার করি। নম্বর ভিত্তিক বিচারব্যবস্থায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। প্রায়শই অন্ধভাবে নির্ভর করি। যেমন, রেজুমে স্ক্রিনিং ও শর্ট লিস্টিং স্টেইজে আমাদের জব পোর্টালের ATS সিস্টেমের কারিশমা নানা অ্যালগরিদমের ওপর বেসিস করে বেশিরভাগ প্রোফাইল ও ক্যানডিডেচার বাতিল করে দেয়, খুব ছোট একটা তালিকা সে সাজেস্ট করে।

এখানে সংখ্যার খেলা। যারা সংখ্যা বা অ্যালগরিদমে কমপ্লাই করেন না, তারা বাদ পড়েন। কিন্তু, ফ্যক্ট হল, রেজুমে ও প্রোফাইলের হায়ার ATS কমপ্যটিবিলিটি একটা গুন বটে, তবে সেটা এমপ্লয়্যবিলিটির খুব ছোট একটা অংশ। অথচ, এই ছোট অংশটা, মানে হরমুজ প্রনালি পার হতে না পেরে যোগ্য ক্যনডিডেট দেখা পান না ইন্টারভিউয়ারের, এমপ্লয়ার দেখা পান না হয়তো সেরা লোকটার। সংখ্যার বিপত্তি। ATS বা এরকম স্মার্ট সিস্টেমের জগাখিচুড়িও থাকে। সেটা নিয়ে অন্যত্র লিখেছি।

আবার, এইচ.আর বসের কাছে শুধু প্রাথমিক টেস্টগুলোর নম্বরের ভিত্তিতে হায়ার স্কোরারদের ফাইলগুলোই ফাইনাল ভাইবা বা ডিসিশনের জন্য উপস্থাপিত হয়। লোয়ার নম্বর যাদের, তারা বা তাদের প্রোফাইল বা ফাইল এইচ.আর বসের চেহারা দেখারও সুযোগ পায় না। বস মনে করেন, হায়ার নম্বর যারা পেয়েছে, বিশেষ করে আমার সুপার সিস্টেম পার হয়ে, তারা নিশ্চিতভাবেই টপ ক্লাস পিপল। যারা বাদ পড়েছে, তারা ছিল লোয়ার কোয়ালিটি। মানে, নম্বর আমাকে একটা হায়ার ও লোয়ার কোয়ালিটিতে ক্লাসিফাই করে দেয়। নম্বরই হয়ে পড়ে সেখানে আমার পরিচয়, ভাগ্য নির্ধারক। আবার, রেটার, বস বা তার টিম হাইলি নম্বর নির্ভর।

কিন্তু, নম্বর নির্ভর হবার বিপদ আছে। একটু আগেই বলেছি, যে, ডিলিং টিম ও সিস্টেমের গলত ও ব্যাকওয়ার্ডনেস কী বিপদ বানায়। তারপর আরেকটা বিপদ হয়। সেটা ইউনিভার্সাল। নম্বর বিশুদ্ধভাবে একজন মানুষকে রিপ্রেজেন্ট করে না। অতিরিক্ত নম্বর নির্ভরতা একটা বায়াস। আপনি ডিল করছেন বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবথেকে বিচিত্র চিজ নিয়ে, যার নাম মানুষ। নম্বর নির্ভরতা আপনার সিস্টেম, প্রাকটিস, প্রসেস তথা ওভারঅল কালচারকে Humane করতে দেয় না। অথচ সেটা Humane হওয়াটা খুবই দরকার।

আমি একটা টাটকা চাক্ষুস উদাহরণ বলি। এক ভদ্রলোকের সাজেশনে একটা অনলাইন সাইটে একটা অ্যাপটিচুড টেস্ট দিতে বসলাম। সিচুয়েশনাল রিজনিংয়ের প্রশ্ন। ৪ টা উত্তর দেয়া থাকে। আমাকে সবচেয়ে যথাযথ একটা আর সবচেয়ে অকার্যকর একটা উত্তর টিক মার্ক করতে হবে। পাশেই আবার সঠিক উত্তরও দেখা যাবে। আমি মার্ক করে সঠিক উত্তরের সাথে ক্রসচেক করতে গিয়ে দেখি, তারা যেটা সবচেয়ে অকার্যকর বলেছেন, সেটা তাত্বিকভাবে ঠিক থাকলেও, বহু বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি দেখছি, অন্য আরেকটা সঠিক হত। এবং, আমি এত বছরের গ্রাউন্ড অভিজ্ঞতায় জানি, আমি ঠিক ভাবছিলাম। কিন্তু, স্রেফ সিস্টেমের লিমিটেডশন আমাকে জিরো পাওয়াচ্ছে। যদিও আমি ঠিক।

এখানেই বিপদ। একটা মেকানাইজড সিস্টেম, রিজিড ও স্ট্যাটিক টেস্ট (যেটা মূল্যায়ন প্রসেসের অংশ) ডিজাইন করা হয় মেকার বা ড্রিমারের মনের মতো করে। হ্যা, অনেক ভেবে চিন্তে করা হয়, তারপরও তো সেটা একটা নির্দিষ্ট মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে ক্যারি করে। আরও ভাল করে বললে, সেটা HR বস (বা তারও চেয়ে খারাপ হলে তার কোনো স্যাঙ্গাতের) মনোভাবকে রিপ্রেজেন্ট করে তৈরী। এখন সেই সিস্টেম তো কাউকে যখন বিচার করবে, তাকে লো-স্কোরার দেখাবে, কারন, তার অ্যাপ্রোচ অব সিয়িং ও মেধা ভিন্ন হতে পারে। শুধুমাত্র অ্যাপ্রোচ ও POV এর ভিন্নতা (কিছু ক্ষেত্রে প্রার্থীর এক্ষেত্রে আপার হ্যান্ড হওয়ার কারনে) একজন প্রার্থীকে লো-স্কোরড গ্রেডিং করে ফেল করাচ্ছে।

৭. অঙ্কের একাঙ্কিকায় আপনি স্রেফ একটা বাড়তি ডিজিট, বাড়তি আদম

আধুনিক সভ্যতায় পরিবারে, সমাজে, মহল্লায়, রাষ্ট্রে, কর্পোরেটে আপনি মি. অমূক নন, আপনি সমূক নন, আপনি মানুষই নন। আপনি স্রেফ একটা নম্বর।

একাঙ্কীকা নাটকের হিরো তথা একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের পুরুষ কর্তার একটি গড়পড়তা দিন কেমন কাটে? কোথায় ব্যয় হয় তার জীবন? আসুন দেখি একটা মজার হিসেব। ১০০ ভাগ নির্ভুলতা আশা না করা উচিৎ। অফিস ও অফিসের প্রস্তুতি/প্রত্যাবর্তন = ১৪ ঘন্টা (সকাল ৭ টা হতে রাত ৯ টা) গড় ঘুম = ৬ ঘন্টা; বাচ্চার পড়াশোনার তদারকি = ০.৫ ঘন্টা; সাপ্তাহিক ও মাসিক বাজারের ১ দিনের গড় সময় = ০.২ ঘন্টা; কাপড় ধোয়া ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছনতা = ০.২ ঘন্টা; বছরে কমপক্ষে ৩-৪ বার ডাক্তার ভিজিটের মাসিক তথা দৈনিক গড় = ০.০৫ ঘন্টা; বছরে কমপক্ষে ৫ টা সোস্যাল ইভেন্ট ভিজিটের মাসিক তথা দৈনিক গড় = ০.০৮ ঘন্টা; বছরে কমপক্ষে ২ বার বাচ্চার স্কুল ইভেন্টের মাসিক গড় = ০.০১ ঘন্টা; মাসে কমপক্ষে ৪ দিন জ্যামে পড়ে রাস্তায় বাড়তি সময়ের দৈনিক গড় = ০.২৫ ঘন্টা; বাসার বিভিন্ন ইউটিলিটি সংক্রান্ত কাজে দৈনিক গড় সময় = ০.০৬ ঘন্টা ; সবমিলিয়ে একটি ২৪ ঘন্টার দিনের প্রায় ২১.১৫ ঘন্টা সে হয় ঘুমে বা অন্যের পেছনে কাটায়। তার নিজের জন্য বরাদ্দ মাত্র ২.৮৫ ঘন্টা।

পরিবারে আপনি কতটা দায়ীত্ব পালন করেন, কত আয় করেন-সেই অনুযায়ী একটা ক্রম নম্বর আপনার আছে। আমরা পুরুষরা অন্যের অংক খাতার কিছু অঙ্ক হতেই জন্ম নিই?

সমাজে আপনি নেহাতই একজন বাড়তি সদস্য মাত্র।

জিন্দা থাকতে আপনার মানিব্যাগ, গাড়ির মডেল ও ফ্ল্যাটের জেল্লার লেভেল নম্বরটাই আপনার নম্বর। মসজিদে কত ডোনেট করেন, আর, স্কুল কমিটির তালিকায় কত নম্বরে সিরিয়াল-সেটাই আপনার নম্বর।

মরলে আপনার নাম নেই, পরিচয় নেই, আপনি তখন-মিরপুর ২ নম্বরের, ৪ নম্বর রোডের, ৩ নম্বর বাসার, ৭ নম্বর ফ্লাটের ১ নং সদস্য তথা মাইয়েত মাত্র।

মরা মাত্র আপনি গোরখোদকের কাছে একটা নতুন কবর নম্বর।
মোল্লা সাহেবের জাব্দা খাতায় মহল্লার সবশেষ জানাজার একটা নম্বর।
ইন্টারনেট ও ডিশ প্রোভাইডারের খাতায় একটা কেটে দেয়া নম্বর।
অফিসের পাঞ্চ মেশিনে আপনি একটা ডিলিটযোগ্য নম্বর।
মহল্লার মুদী দোকানে আপনি বাকির খাতার একটা বাতিল নম্বর।

রাষ্ট্রেও আপনি আদম শুমারীর তালিকায় ১৭ কোটির পরে একটা নতুন নম্বর মাত্র। হয়তো আপনার নম্বর ১৭ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার, ৯ শত নিরানব্বই। রাজনৈতিক দলের কাছে আপনি একটা ভোট। বেঘোরে দুর্ঘটনায় মরলে আপনি একটা লাশ নম্বর। পুড়ে কয়লা হয়ে গেলে আপনি একটা সিরিয়াল অব ম্যাটেরিয়াল নম্বর। ডি.এন.এতেও পরিচয় না মিললে বা কেউ ক্লেইম না করলে আপনি কবরখানায় একটা বেওয়ারিশ নম্বর।

সারাটা জীবনই আমরা এই নম্বরের নামতার অঙ্ক হয়ে বাঁচি। বেঁচে থাকার পুরো সময়টা ডিজিটাল চোরাবালিতে অসংখ্য বাইনারীতে বিভক্ত হয়ে, কিছু অ্যালগরিদমের উৎপাদকে বিশ্লেষণ হয়ে মেকি স্বাধীনতা উপভোগ করি। মৃত্যুতে নম্বর হয়ে মর্গে বা কফিনে শুয়ে আমারই মতো কিছু নম্বরধারীর নানা অভিনয়ে আমাকে চিরবিদায় দেয়া দর্শন করি।

#socialmediaaholic #socialmediahype #socialmediadomination #socialmediadestruction #digitalslavery #techdomination #privacy #digitaldomination #spying #silentobserver #slaveofnumber #slaveofdigits #metricbasedlife

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *