Skip to content

কৃষকের কান্না আর চামড়া নিয়ে তেলেসমাতি

  • by

‘কম দামে কেনো, বেশি দামে বেঁচো’-সারা দুনিয়া জুড়েই আবহমান কাল ধরে ব্যবসার এই হল কমোন ও সার্বজনীন ব্যকরণ।

তবে এই কেনা ও বেঁচার মধ্যে একটি মোটামুটি অঘোষিত কিন্তু সর্বজনগ্রাহ্য স্বরলিপি সব দেশ মেনে চলে। সেই প্রথাগত স্বরলিপির নাম নৈতিকতা, ঐতিহ্য এবং মার্কেট ফোর্স ও ট্রেন্ড।

সেই ফোর্স ও ট্রেন্ডের বদৌলতেই দুই টাকার ম্যাচবাত্তি হতে শুরু করে বিলিয়ন ডলারের মিজাইল-সবকিছুরই উৎপাদন খরচ, ক্রয়মূল্য ও বিক্রয়মূল্যে একটি অঘোষিত ইকুইলিব্রিয়াম বজায় থাকে। উৎপাদক হতে ভোক্তা-সবাইই একটি রিজনেবল প্রাইস পায়। কেউ লাল আর কেউ *ল-এমনটা হয় না। (খুব সামান্য ব্যতিক্রম বাদে)

কিন্তু জগতের সকল ব্যকরণ খেই হারায় বঙ্গদেশে এসে।

এই দেশে কত্তিপক্ক চামড়া ’কিনবার’ ’সর্বোচ্চ’ দাম বেঁধে দেন। কিন্তু এই কত্তিপক্ককে কখনো দেখি না, চাল, ডাল, তেল, আলু, লবণ, মরিচ, পেয়াজের দাম বেঁধে দিতে। সেটা করতে দাবী তুললেই বিজ্ঞের মতো বলবে, “ না না, মুক্তবাজার অর্থনীতের পূজারী আমরা, মুক্তবাজারে দ্রব্যের দাম বেঁধে দেয়া সম্ভব না।” (চামড়া বোধহয় দ্রব্য না, অপদ্রব্য)।

অবশ্য কত্তিপক্ক মাঝেমধ্যে গরুর মাংস, চালের দামটা কোনো এক অদ্ভূৎ কারণে নির্ধারন করে দেন। যদিও সেটা কেউ মানে না।

একইভাবে কত্তিপক্ক চামড়ার সর্বোচ্চ ক্রয়মূল্য ধরে দেন-প্রতি বর্গফুট ৪০-৪৫ টাকা। তাতে একটি গরুর চামড়ার দাম অন্তত দাড়ায় হাজার টাকা।

কিন্তু, ওই যে, কত্তিপক্ক তো সর্বোচ্চ দাম বলেছে। সর্বনিম্ন কত হবে তাতো বলে নাই। ফলাফল-চামড়ার একমাত্র ও এ্যাবসলুড God ট্যানারি মালিকের মর্জিমতোই ফাইনালি চামড়ার বাজার চলবে। চামড়া তো চাল, আলু, বিড়ি, ফান্টা না, যে, ভাল দাম না পেলে ধরে রাখব বা বেঁচব না। ট্যানারকে চামড়া দিতে সবাই বাধ্য।

আবার, মরার ওপর খাড়ার ঘা, চামড়া রপ্তানী করা যাবে না। আপনাকে হয় ট্যানারের লোভের বলি হতে হবে, না হয় নদীতে ফেলে মাছকে খাওয়াতে হবে। কেউ কেউ অবশ্য চামড়া ভক্ষণের বুদ্ধি দেন। ভাই, আর হাসায়েন না।

অবশ্য দেশের সরকার ব্যাংকগুলোকে প্রতি শত টাকা ঋণের বিপরীতে কত টাকা সূদ চার্জ করা যাবে-সেটি আদেশ দিতে পারে, অথচ কত টাকা ব্যাংক জমা রাখলে কত টাকা সুদ দিতে বাধ্য-তার আদেশ দেয় না। ফলে, গরীবের সামান্য জমা টাকা ফি বছর আরো কমে যাচ্ছে।

পৃথিবীতে এই একটাই দেশ, যেখানে ব্যাংকে টাকা রাখলে কমে যায়। ইঙ্গিত ও ইচ্ছাটা পরিষ্কার। ব্যাংকে টাকা রেখো না। খরচ করো, আরো খরচ করো। তুমি এখন ধনী দেশের নাগরিক, খরচ না করে কেন জমাবে? শেয়ার বাজারে ঢালো আর পথে বসো।

যাহোক, আমার ন্যাংটো বেলা হতে আজকের এই দুই কুড়ি বয়সের জীবনে খুব রেয়ার কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আজীবন দেখলাম, সব জিনিসের দাম ৪০ বছর আগের তুলনায় অন্তত ৫-১০ গুন বেড়েছে। গরুর মাংসের কেজি আমার ১০ বছর বয়সে ছিল ৭০ টাকা। সেটা আজ ৬০০ টাকা। এক কেজি মোটা চাল ছিল ১৮ টাকা, সেটা ৪০ বছর পরে ৫০ টাকা। একটা ৩ মণি গরুর দাম ছিল ৫০ হাজার টাকা। আজকে সেটা ২.৫ লাখ টাকা।

ব্যতিক্রম কেবল গরুর চামড়া। ছোটবেলায় দেখতাম, গরুর একটা চামড়ার দাম ১ হাজার হতে ২.৫ হাজার টাকা। কী তেলেসমাতি ঘটল জানি না, দেশে একটা গরুর চামড়ার দাম ২০০ টাকায় নেমে গেছে। দেশ ধনী হলে বোধহয় এমনই হয়।

আবার এমনও না, দুনিয়া হতে চামড়ার জিনিসের ব্যবহার উধাও হয়ে গেছে। জুতার দাম ঠিকই ৮০র দশকের ১৫০ টাকা জোড়া হতে ২৫০০ টাকা জোড়া হয়েছে।

আপনি হয়তো বলবেন, বাজার মূল্য বাজারের নিজস্ব নিয়মে ওঠানামা করবে। জ্বি ভাই, সেটা তো ঠিক। কিন্তু কেবল চামড়ার দামেই বাজারের ব্যকরন কাজ করল? পানির দাম, গ্যাসের দাম, জ্বালানীর দাম, কাগজের দাম, মদের দাম, লবণের দাম-সব বাড়ল। কমল কেবল চামড়ার?

এবারের কোরবাণী দাতাদের সিংহভাগ নিশ্চয়ই এইবার গরু কিনে খুব খুব তৃপ্ত। দুর্জনেরা রটিয়েছে, ২০ তারিখে নাকি ১০ লাখ টাকার গরু ২ লাখে কিনে বগল বাজাতে বাজাতে বাজার ছাড়তে পেরেছেন ক্রেতারা। ক্রেতারা তো এটাই চান-কম দাম, ভাল পণ্য। তাদের দোষ নেই। কিন্তু, উৎপাদকরা কী দোষ করলেন? তাদের ভাল দাম কে নিশ্চিত করবে? এই দেশের প্রতিটি কাঁচা পণ্য উৎপাদক, অনেক ক্ষেত্রে পাকা পণ্য উৎপাদক যুগ যুগ ধরেই নিস্পেষিত, শোষিত ও বঞ্চিত।

উৎপাদককে ঠকানোটা যেন সাপ্লাই চেইনে ওপরের দিকে থাকা সবার বাধ্যতামূলক একটা খাসলত। এই ঠকানোর কাজটা হয় খুবই কাঁচা ও খোলাখুলিভাবেই। আমি নিজে দেখেছি, সবজি ক্ষেতে সবজির প্রচুর ফলন। পাইকার বা বেপারীরা এসে বলত, “ও মিয়া, বাজারে অহন কাস্টমার কম, বেগুন মাইনসে খায়নি, টমেটোর সিজন শেষ, অহন দাম পাই না। বাজারে চাহিদা নাই। ৩ টেহা কেজি দিলে দেও, না দিলে যাও।”

দাম দুম করে পানির দরে নেমে যায়।

তারপর যখন সেই পণ্যই বাজারে চলে যায়, ক্রেতারা কিনতে আসে, তখন সুর ধরে, “কিছু করার নাই দাদা, মোকামে মাল নাই, ক্ষেত্রে এহন বেগুন নাই, বন্যায় ফসল নষ্ট অইছে, চালান কম কাস্টমার বেশি। দাম তো বেশি অইবই।” ব্যাস, দাম আকাশ ছোঁয়। সাতক্ষিরায় যখন টমেটো বিক্রী হয় না, হলেও ১ টাকা কেজি, তখন ঢাকায় টমেটোর কেজি ৫০ টাকা। উৎপাদক কখনো দাম পায় না। ধানের দাম তো কৃষকের জন্য এক গজবে পরিণত হয়েছে। অথচ এই কৃষকরা নিজেদের স্বার্থ বলি দিয়ে ধান ফলান। আমাদের খাদ্য যোগান।

ভারত পেঁয়াজ বন্ধ করল, আমরা শহুরে সুবিধাবাদীরা বিপদে পড়লাম। আমরা গেঁয়ো অশিক্ষিত কলুর বলদ গিনিপিগ চাষাদের প্ররোচিত করলাম, পেঁয়াজ চাষ করো, লাল হয়ে যাবে। ফলাফল, পেঁয়াজের বাজার নেমে যাওয়ায় লস। ইন্ডিয়া গরু পাঠানো আটকে দিল। আমরা ধনী ও শহুরে সমাজ গোশ খাবারে টান পড়বে বিধায় আবারো খামারিদের প্ররোচিত করলাম, গরু চাষ করো। লাভ হবে। লাল হবে। ফলাফল-কোনো হিসাব ও ডাটা, প্রোজেকশন নাই, দেশজুড়ে মাত্রাতিরিক্ত গরুর চাষ হল, স্বাভাবিকভাবেই যোগান বেশি, ক্রেতা কম। এবারতো করোনার প্রকোপে ক্রেতার সংখ্যা আরো কম।

ফলাফল, গরুর দাম পানির দামে নেমে গেল।

হ্যা, গরুর দাম নির্ধারনের আন্তর্জাতিক নিয়ম এই দেশে বলবত নেই। তাই গতানুগতিক পথে দাম চাওয়া ও বিক্রী হয়ে থাকে। যার ফলে কেউ লাল হয়, কারো বিক্রী না হওয়ায় বা হলেও পানির দামে বেঁচতে বাধ্য হওয়ায় চোখ কেঁদে কেঁদে লাল হয়। অনেকেরই ক্ষোভ আছে, ব্যপারীরা দুই টাকার গরু প্রথমে ১০ টাকা চায়, তার পরে বিক্রী হয়না, পরে ১ টাকায়ও দেয়। হ্যা, মানছি, এটা হয়। কিন্তু, তাই বলে কি ১০ লাখ টাকার গরুটা রাতারাতি ১ লাখ টাকার গরু বনে যায়? মানছি, গরুর দাম নির্ধারনের স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম এদেশে মানা হয় না। ইদানিং, অনলাইন বেঁচা বিক্রী আসায় সেই নিয়ম কিছুটা মানা হচ্ছে-(লাইভ ওয়েটের বিপরীতে প্রতি কেজি ওজন দরে)। কিন্তু, সেই সিস্টেমে তো এখনো ৯৯% পশুও আসেনি। এখনো তো সব সনাতন। মানছি, সেই কারনে, কৃষক বা ব্যপারীরা নানা কারনে, ভাইরাল হতে, হাইপ তুলতে গরুর দাম ৫০ লাখ চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু, কত্তিপক্ক কি এটুকু অন্তত করতে পারে না, যে, সারাদেশে এখন হতে লাইভ ওজনের ভিত্তিতে কয়েকটি ক্যাটেগরী করে গরুর দাম কেজি প্রতি ফিক্স করে দেয়া হবে আর সবাই সেটা মেনে গরু বেঁচবে? খুব কি কঠিন?

৯০ লক্ষ পশু বিক্রী ও জবাই হয় যেই দেশে সেখানে পশুর বাজার নিয়ে কোনো ডাটা ও এনালিসিস নেই। কোনো প্রজেকশন নেই, কোনো মার্কেট এনালিসিস নেই, কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত ও পরামর্শ নেই। আন্দাজে গরু জন্মাও, গরু পালো, বড় করো, পয়সা ঢালো আর ইদের সময় এসে ধরা খাও। প্রাণী সম্পদ দপ্তর কি এই কাজটাও করতে পারে না? নাকি লকডাউনে এটা করাও নিষেধ থাকে?

তবে একটা জিনিস খুব জানতে ইচ্ছে করে।

একজন খোদাবন্দ মানুষ, যিনি খোদার রেজামন্দীর জন্যই কোরবাণী দিলেন, তিনি যখন বাজারে গিয়ে দেখেন, ১০ লাখ টাকার গরুটা ব্যপারী বা কৃষক ২ লাখে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, তখন কি তার এরকমটা মনে হওয়াটা খুব অসম্ভব, যে, না, আমি তো খোদার জন্য ১০ লাখ টাকা খরচ করতে তৈরীই ছিলাম, আমি ১০ লাখ টাকার গরু ১ লাখে নেব না। তাকে কিছু বাড়তি পয়সা দিই? লোকটা অন্তত পরিবার নিয়ে কয়েকটা মাস ভাল থাকুক?

অনলাইনে পশু কেনাবেঁচার একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে। প্রতিবছরই বাড়ছে অনলাইন বিক্রী। এই সিস্টেমে একটা দিক ভাল হবে। অনেকগুলো অসঙ্গতি কমে যাবে। কিন্তু আমি শংকিত অন্য দিক নিয়ে।

আমাদের গরু-ছাগলের সিংহভাগ পালক বা উৎপাদক কিংবা বিভিন্ন বাজারে যারা পশু কিনে নিয়ে আসেন বিক্রীর জন্য, মানে বেপারী-তাদের সিংহভাগই অশিক্ষিত, আইসিটির ওপর তাদের দখল প্রায় জিরো। এইসব সিস্টেমে তারা এখনো অভ্যস্তও নন, তাদের গণ একসেসও এখনো তৈরী হয়নি। ফলে, এই অনলাইন পশু কেনাবেঁচার ট্রেন্ডে এই গরীব কৃষক ও দরিদ্র বেপারীরা, যারা এই পশু কেনাবেঁচার সামান্য লাভে বছরের কয়েক মাসের খোরাকি জোগান, তারা আরেক দফা মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষনের শিকার হতে পারেন। তাদের ভাগ্য ও অধিকার সুরক্ষায় কেউ নেই।

#Eidcelebration #leatherprice #exploitation #leatherbusiness #exploitation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *