বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পরম সুহৃদ সাইমন ড্রিং চলে গেলেন। আমি জানি, সাইমন ড্রিংকে উন্নত দেশ বাংলাদেশের অনেকেই এখন চিনবেন না।
এই সেদিন রূপের গঞ্জে ৫২ জন মানুষ পুড়ে কয়লা হয়ে গেলেন। আজকে তাদের কথা ছিল বোনাসের সামান্য টাকায় পরিবার নিয়ে সেমাই খাবার।
আশার আলো জ্বালিয়েও সবাইকে কাঁদিয়ে শেষতক পরশু চলে গেল আমাদের বন্ধুর ক্যানসার আক্রান্ত ফাইটার অথচ অবুঝ সন্তানটি।
১৬ মাসে সমবয়সী, ব্যাচমেটদের মধ্যে চেনা-অচেনা অনেকগুলো প্রাণ চলে গেছে।
ইদের দিনেও বোমা হামলা হল ইরাকে। ঈদের নামাজরত মালি প্রেসিডেন্টের ওপর ছুরি হামলা হল কাল। ঈদ ও ত্যাগের উৎসব হামলাকারীদের জিঘাংসা বৃত্তিকে দমাতে পারেনি।
৫০/৬০ টি জীবন্ত গরু সমেত ট্রলার ডুবে গেল সেদিন নদীতে। ৫০ জন ব্যাপারীর বুক ভেঙে। পানিতে ডুবে মরার সময় কি গরুদের শ্বাসরুদ্ধ হবার যন্ত্রণা বোধ হয়? ধুর ছাই, কী সব ভাবি? পশুদের আবার অনুভূতি, যন্ত্রনা থাকে নাকি?
অক্সিজেন আর ভর্তি করার মতো সীটের অভাবে সন্তানের কোলেই অক্সিজেনের অভাবে দাপাতে দাপাতে সেদিন করোনায় মারা গেলেন এক পিতা। অন ক্যামেরার সামনে।
কোভিডে পড়ে নিজের জীবনের ১৪ টি মূল্যবান দিন খোয়ালাম গত কিছুদিনে। অসহ্য এক অনিশ্চয়তার ১৪টি দিন।
হাসপাতালে পড়ে আছেন বাবা-মা। বাসায় তাদের মূক ও বধির সন্তান একা একা দিন গুনছে অনিশ্চয়তায়। মাঝে মধ্যের ভিডিও কলই সান্তনা।
একসময়ে সচ্ছল ও আত্মনির্ভর জীবনযাপন করা অসংখ্য অসংখ্য অসংখ্য সুহৃদ মহামারীতে কাজ, পেশা, ব্যবসা, আয়ের উৎস হারিয়ে অমানুষের মতো জীবন কাটাচ্ছে অন্ধকার জীবনে। তাদের সাথে কথা হলে নিজেকে নিজে মাটিতে দাবিয়ে দিতে মন চায়।
কতগুলো বলব?
বিগত ১৬টি মাস কমবেশি এরকমই চলছে আমাদের এইসব দিনরাত্রি। কোভিডের ছোবল শুরু হবার পরপরই লিখেছিলাম, এই কোভিড আমাদের জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তাকে একদম দুমড়ে, মুচড়ে নিংড়ে দিয়ে নিঃশেষ করে দিতে আসছে। এর নিধনযজ্ঞ যেদিন থামবে, সেদিন হয়তো, দেখব, সে এক এতিমে পূর্ণ বাংলাদেশ রেখে গেল।
বাস্তবে হচ্ছেও তাই। ঘরে ঘরে এতিমের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিনই শ দুয়েক ঘরে মাতম উঠছে। রোজই এতিম হচ্ছে, বিধবা হচ্ছে, সন্তানহারা বা মাতৃপিতৃহারা হচ্ছে শ’দুয়েক মানুষ।
এর ভিতরেও আসে ঈদ। থেমে থাকে না ঈদ আনন্দ। (অথবা, ঈদ মাস্তি)। গতকাল এলাকায় ব্যপক বাজি ফুটোনোর মচ্ছব হয়েছে। আফটার অল ঈদ এসেছে। রোজ রোজ কতজন মরল, তাতে আমার কী?
সত্যিই তো, একসময় মন খারাপ করলেও, ইদানিং ভাবি, আসলেই মানুষের কার কী যায় আসে? আর মানুষ আসলে কী করবে? কোথায় কোনখানে দুইশো মানুষ মরল, তার জন্য কি সে গরু কিনবে না? গোসত খাবে না? নতুন জামা পরবে না? অচেনা দুশো মানুষ মরেছে বলে কি সে বাড়িতে ইদ করতে যাবে না? সে কি ঘরে দোর দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদবে? না তো। আসলেই, এই মরার দেশে হররোজই এত এত বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে, সেগুলো ধরতে গেলে তো আমাদের নিত্যজীবন অচল হয়ে যাবে।
করোনা, মৃত্যু, দুর্যোগ, মহামারী, মৃতের পরিবারে মাতমের রোল, ৫২টি কয়লা হওয়া লাশ, ৫০টি শ্বাসরুদ্ধ গরুর তীব্র বাঁচার আকুতি, গাবতলির হাটে গরু বেঁচতে না পারা কৃষকটির বুকফাটা কান্না, দামে কম-মানে ভাল-গোস্তে জেতো-গোস লোভীদের এমন উদগ্র অন্যায় কামনার কাছে পরাজিত গরুর মালিকের বুকফাটা কান্নার ধ্বনি আজ সকালের ঈদের নামাজের আনন্দের কাছে মিলিয়ে গেছে। সেই ব্যাপারীদের অমানুষিক কান্নার শব্দ চাপা পড়ে গেছে বিজয়ীদের কলোরবের মাঝে, ছুরির নিচে গলার গলকম্বলে যখন পোঁচ পড়ে, তখন যে গড়গড় শব্দটা হয়, তার নিচে চাপা পরে গেছে গরুর কৃষকদের চাপা কান্না। ওরা আসলে বেওকুফ। এই স্যাকরিফাইস, এই পানির দামে বেঁচতে পারার স্যাকরিফাইসটাই তো শহুরে বাবুদের ভাষায় এই উৎসবের থীম।
এই নগর, এই দেশের গ্রাম জনপদ এখন গোস সংগ্রহ, গোসে জয়-পরাজয়ের নিক্তি মাপা হিসেবে মত্ত। গৃহিনীরা গোসের নানা পদ রান্নার সব প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ব্যস্ত। যদিও জানি না, যেই বন্ধুর অবুঝ সন্তানটি পরশু চলে গেল, তার ঘরে আজ কী চলছে? ওর মা কি জীবনে ফিরতে পেরেছে দু’দিনে? গতকাল যে ২০০ মানুষ মরল, তাদের বাসায় কি আজকে পশু জবাই হল? ঈশ্বরের জন্য পশু জবাই করা সবাই কি মনের পশুকেও জবাই করতে পারল?
চাকরি হারিয়ে, ব্যবসা হারিয়ে বিগত ১৬ টি মাস যেসব মানুষেরা শূন্যতায় ডুবে আছে-তারা আজকে কী করছেন? যারা আজকে এই দুরবস্থার দিনেও দামে কম-গোসে বেশি গরু কাটতে সক্ষম হচ্ছেন, তারা আজকে কী ভাবছেন? ফ্রিজের আকার ও ধারনক্ষমতা নিয়ে চিন্তিত হচ্ছেন, নাকি ছবির ওপাড়ের শূন্য দৃষ্টির মানুষদের কথাও ভাবছেন?
আমি জানি না। জানতে ইচ্ছেও করে না। আমার কেবল পাগল পাগল লাগে।
আমি জানি, আজকের এই ঈদের দিনে আপনাদের এইসব প্যাঁচাল ভাল্লাগবে না।
কী করি বলুন, আমার ধরনটাই এমন। আমি এর বাইরে যেতে পারি না। আমাকে এগুলোই যে বারবার পোড়ায়, ভাবায়, কীবোর্ডে বসায়।
কুরবাণীর দিন আমি বিকেল তিনটা চারটা তক বারান্দায় যাই না। নিচে নামি না। এখন তো মহামারীর দিন। বাইরে তো আরো নামি না। না, প্রোটোকল ভেঙে আমি মসজিদে জামাতে ঈদের নামাজ আদায়ের উন্মত্ততার মতো অবিমৃষ্যকারীতা করি না। ঈদের দিনের সকালের ফজরের নামাজ না পড়লেও ঈদের নামাজ পড়ার তীব্র আকূতিরও মানে ধরতে পারি না। আবার, যারা যায়, তাদের অভিসম্পাৎও করি না। করুক, ব্যক্তিস্বাধীনতা। মানুষ কত আর নিজেকে গুটিয়ে রাখবে? কতটা আর সম্ভব? রাষ্ট্র ও তার নিয়ন্ত্রকরাই যখন অসহ্য অবিমৃষ্যকারীতায় তার মানুষদের ভাসিয়ে দেয় বছরের পর বছর, তখন মানুষ আর কত লুকিয়ে রাখবে নিজেকে? কত আর স্যাকরিফাইস করবে? কীসের আশায়ই বা করবে? আসলে, আমাদের এই নতুন ধরনের জীবন বাস্তবতায়, সত্য-মিথ্যা, সঠিক-বেঠিকের মাপকাঠিটা নিয়ে আমরা সবাইই বড্ড কনফিউজড হয়ে গেছি।
ব্যক্তিগতভাবে আমি পশু জবেহ সহ্য করতে পারি না। হাত-পা বাঁধা পশুটির তীব্র আর্ত চিৎকার আমি নিতে পারি না- তাই জানালা বন্ধ রাখি, বারান্দায়ও যাই না। (না, আমি নিরামিশাষী নই, পশু হত্যার বিরোধীও নই। করুক, যার যা নিজস্ব পছন্দ। আল্লহ’র আদেশের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক পারসপেকটিভ পূরণে নিশ্চয়ই এই প্রথার দরকার আছে। তবে হ্যা, মাংশাষী পশুর মতো গোস খাবার লোভ মাথায় রেখে, সামাজিকতা ও লৌকিকতার নিয়তে খোদার আদেশকে ঢাল বানিয়ে পশু হত্যা এবং হত্যাকে আনন্দ উৎসবে পরিণত করাতে, একটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যপূর্ণ অনুষ্ঠানকে মাস্তিতে পরিণত করার গণউৎসবে আমার আপত্তি আছে।) বিকেলে সব ধুয়ে মুছে গেলে কখনো কখনো পথে নামি। হাঁটি। আজও হয়তো তাই করব।
এমনিতে সামাজিকতা ও বন্ধুবাৎসল্যের দায় তো আমার কোনোকালেই ছিল না। আমাদের দু’জনকে সামাজিক সঙ্গ দেবার দায়বাহি তেমন কেউ নেইও। ফলে, উৎসবে নিজেদের মতো চলবার একটা অবারিত সুযোগ পাই আমরা। আজও সেই সুযোগ নেব। খুব হাঁটব আজ।
এই নগরের পথে পথে হাঁটব। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হব। পথ দেখব, বৃষ্টিতে আধা-লোহিত বর্ণ ধারন করা কালো পিচের রাজপথের চেহারা দেখব, পথে পথে সত্যিকারের অভাবীদের নতমস্তকে শূন্য দৃষ্টিতে ঘুরতে দেখব, সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে ১ নম্বর বাজারের ঢালে তাদের চুপি চুপি কিছু ছাটি গোশত কিনে চকচকে চোখে ফিরবার আনন্দ দেখব, পথে পথে আজ সত্যিকারের অভাবী আর তাদের পাশেই লোভীদের মিশেল দুচোখ ভরে দেখব। তাল তাল মাংস সুন্দর করে সাইজ করে ফ্রিজে জমিয়ে রাখাদের হয়তো দেখার সুযোগ হবে না। সেই কাজটি হবে ঘরের কোণে, গোপনে।
আমি এক নেগেটিভ সত্ত্বা। বিদ্যুৎ নামটি কি সেজন্যই বাপ-মা রেখেছিল?
পথে পথে আজ নেগেটিভিটি খুঁজব। নেগেটিভ এনার্জিতে নিজেকে আরও তাতাব।
আর তারও পরে, রাতে ঘরে ফিরে ক্লান্ত শরীরে ইনবক্সে আসা সবগুলো শুভেচ্ছা বার্তার জবাব দেব। ত্যাগ ও ভোগের এক যুগপত বাঙাল উৎসবের শুভকামনায় ইনবক্সটা ভরে থাকে। আমার সকল সুহৃদ ও হেটারদের ত্যাগোৎসবের শুভকামনা।
#festivalforvagabonds #Eidfestival #Eidcelebration