শৈশবে, আমাদের কলোনীর কাছেই কোথাও একটি মসজিদ ছিল। ফজরের আজানের ঠিক আগমুহূর্তে মোয়াজ্জিন একটি দোয়া-শ্লোক-মন্ত্র-যেটাই বলি, খুব সুরেলা আওয়াজে বলতেন,
”আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি, আহইয়ানা, বা’দা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর।”
আধো ঘুমন্ত আধো জাগ্রত শিশুমনে সেই উচ্চারনের অর্থ জানা না থাকা সত্ত্বেও তার সুরটি ঠিকই একটি দ্যোতনা সৃষ্টি করত। একটু বড় হবার পরে সেই মন্ত্র-দোয়ার অর্থ শিখি। আজও যতটা মনে আছে, তার মোটামুটি ভাবার্থ হল, যে, ঘুম নামক অর্ধমৃত অবস্থা হতে আবার জীবনে ফেরত আনার জন্য আল্লহ’র প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং এটা পুনঃস্মরন করা, যে, আমরা আবার তার কাছে ফেরত যাব।
সেই সময় হতে বিষয়টি মাথায় গেঁথে গেছে। প্রতিবার, প্রতিদিন যখনই ঘুম হতে উঠি, এই কথাগুলো মনোজগতকে একবার হলেও নাড়া দেয়। ভোরের পৃথিবীর নিরবতায় নিজেকে আরেকবার ধরনীর বুকে জীবিত দেখে কৃতজ্ঞতা চলে আসে। মনে হয়, আহ, বেঁচে আছি। বেঁচে আছি। বেঁচে আছি।
জীবন মূল্যবান। মানুষ হিসেবে জীবন এক বড় প্রাপ্তি। কত কত অর্থবহ করা সম্ভব এই জীবন। কত কী করে যাবার আছে এই জীবনে। তাকে আরেকবার ফেরত পেয়ে, আরও একটি সুযোগ পেয়ে তাই মন নিজে হতে কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে।
সে আপন মনে বলে ওঠে-আলহামদুলিল্লা হিল্লাজি……….
বিপুলা এই পৃথিবীর কতটা জানি? নিজেকেই বা কতটা চিনি? কখনো কখনো মনে হয়, একদমই না। বিশেষত, তার নিয়ত গতি পরিবর্তন, তার সদা নতুন ভাবনাতে আচ্ছন্ন হওয়া, তার অন্তঃর্দ্বন্দ্ব, তার নিজের ভেতরে ভাঙা গড়া-এর কোনো কিছুতেই নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সে চলে তার আপন মনে।
নিজেকে আমার বড় ভাগ্যবান মনে হয়। সে শুধু প্রতিবার জীবন ফেরত পেয়েই নয়। যাপিত জীবনের প্রতিটি পরতেই মনে হয়, প্রতিটি স্তরকে উপভোগ কিংবা ভোগ-সবসময়ই মনে হয়-
I am a lucky champ
I am blessed
I am gifted
জীবনকে আশির্বান্বিত, কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ মনে করার জন্য খুব বড় কোনো প্রাপ্তি জরুরী নয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে এই মানবজীবনকে আল্লহ কত কিছুর অনুগ্রহে পূর্ণ করে রেখেছেন-কতটা খোঁজ রাখি তার?
প্রতিটি অর্ধমৃত্যু ঘুমের পরে গত ৪২টি বছরের প্রতিটিতে ৩৬৫ বার করে নতুন জীবন পেয়েছি প্রতিটি নতুন ভোরে-সেজন্য Al Hamdu Lillah
পিতার প্রয়ান হলেও এখনও আম্মাকে এই বয়সেও মা, মা করে ডাকতে পারছি, তার গলা শুনতে পাচ্ছি-তার জন্য Al Hamdu Lillah
এক অদ্ভূৎ নারী অকুন্ঠ্য, নিমগ্ন বন্ধু ও শ্রেষ্ঠ শুভাকাঙ্খী হয়ে তার জীবনে আমাকে জড়িয়ে রেখেছে, সেই বিপুলা নারীর জন্য Al Hamdu Lillah
এক গ্রাম্য পিতার সন্তান হয়ে, এই হৃদয়হীন নগরে তিনবেলা আহারের সংস্থান করতে পেরেছি, হারিয়ে যাইনি লাখো লাখো ঝরে পড়াদের মিছিলে-সেজন্য অহর্নিশি Al Hamdu Lillah
আজন্ম রোগা আমাকে বিগত ২২টি বছরে বড় কোনো অসুস্থতায় পড়ে জেরবার হতে হয়নি-আল্লহ’র সেই অযাচিত অনুগ্রহের জন্য Al Hamdu Lillah
এই নগরের প্রতিদিনের হরিলুটের প্রবাহে ভেসে যেতে হয়নি, এই নিষ্ঠুর মর্ত্যে কিংবা নগর নরকের পদে পদে বিদ্যমান দুঃসহ বিপদ যন্ত্রণায় পড়তে হয়নি-কেন নয় Al Hamdu Lillah?
অল্পশিক্ষিত একজন মফস্বল বালককে তিনি নিজের মুক্ত ডায়েরীতে পাতার পর পাতা নিজের মতো করে, নিজের কথা লিপিবদ্ধ করবার এক ভয়াবহ নেশা ও কাবেলিয়াত দিয়েছেন, আর কী চাই জীবনে? Al Hamdu Lillah
আমি জানি, ওপাড়ের রহস্যময় জীবন-জগতের সান্ত্রীদের কোনো ফেসবুক একাউন্ট নেই। আবার রহস্য বলে, আছে। আমি জানি, আল্লহ ’ফেসবুক ইউজার’ নন। তবে তিনি কী, কেমন, কোথায়, কেন, কীভাবে, কতটা-এসবের বহু বহু বহু অধরা উর্দ্ধে তো-তাই না।
সে যাই হোক, একটি প্রত্যুষ গাত্রোত্থান কত কিছু লিখিয়ে দিল। সে অনেকটা এলোমেলো করে দিল আজকের চিন্তার জগত। চিন্তা-সে এক রহস্য জগত। এই নতুন পাওয়া আরেকটি দিনের চলার শুরুতেই মনে হল, কই, কখনো তো ফরমালি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হয়নি। তবে হয়ে যাক। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ হে বিশ্ববিধাতা। ৪২টি বছরের প্রতিটি সেকেন্ডের জন্য, প্রতিটি পলের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, বোঝা-না বোঝা রহম-সবকিছুর জন্য Al Hamdu Lillah #thankingGod #gratefulness #thankful #contentment #শুকুরআলহামদুলিল্লাহ