Skip to content

লোভের গ্রাস: মিথ্যা ও মেকি স্ট্যাটাসের জাতীয় বেসাতি

সে বহুকাল আগে, যখন আরবের লোকেরা লুঙ্গী পরত না-সেই যুগে আমরা একটি সুখী ও তৃপ্ত মানবজাতি ছিলাম।

আমরা সবাই সন্তুষ্ট ও যার যার মতো সফল ছিলাম। ফেসবুক এসে এক ধাক্কায় আমাদের অসফল, অতৃপ্ত, অসুখী ও অসন্তুষ্ট জীবে পরিণত করে দিয়েছে।

কীভাবে?

আগে একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত বড় সওদাগরি অফিসে মোটামুটি একটি কলম পেষা চাকরি করে মাসে ১৯ হাজার টাকা কামাতেন। হালকা টিপস, কনভেন্স বিল বাঁচিয়ে আয়টাকে টেনে টুনে ২৩ হাজারে নিয়ে যেতেন। ঘরে একটা কঙ্কা ২১ ইঞ্চি টিভি। দেড়টা বাচ্চা। একটা রোগাটে অপুষ্ট স্বাস্থ্যের বউ। ব্যাংকে ৩৫০০ টাকা ব্যালেন্স। মাসে একবার গরুর গোস আসে। বছরে একটা বিয়ের নেমন্তন্ন পড়ে। তাতে বিনা গিফটে গিয়ে সারা বছরের ক্ষুধা তৃপ্ত করে আসা হয়। দুই ইদে না হলেও দুই বছরে একবার গ্রামের বাড়িতে বাবা-মা’কে দেখার নাম করে কিছুটা শেকড় সন্ধান ও অপরাধ স্খলন হয়ে পরিবারটি মোটামুটি সুখীবোধ নিয়েই ছিল।

এই সুখের সংসারে আগুন লাগালো ফেসবুক। যার কল্যানে ওই পরিবারের কর্তা, কর্ত্রী, ল্যান্ডাপ্যান্ডা বাচ্চা-সবাই হঠাৎ একদিন মোবাইলের স্ক্রীনে দেখতে পান তাদেরই চেনা, অচেনা, জানা, অজানা, আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী সবাই কী চাকচিক্যময়, মধুর, সুখী, সচ্ছল, সফল ও বিলাসী জীবন যাপন করছে আর তারা কী নিদারুনভাবে সেখান হতে পিছিয়ে আছে। খোদা তাদের কীভাবে এতদিন বঞ্চিত করেছেন-সেই অনুযোগে মুহূর্তে হৃদয় কলুষিত হয়ে যায়।

জীবনটা এক মুহূর্তে বিষময় হয়ে উঠল। আপাতঃ সুখী পরিবারটিতে ঢুকল ইর্ষা, অতৃপ্তি ও অসুখের বিষবাষ্প। পরিবারের কর্তা ভাবেন, জীবনটা নেহাতই ব্যর্থ। রোগা পটকা কর্ত্রী ভাবেন, এ কী ঘেন্নার জীবন যাপন করলাম, এক কেমন কুৎসিত ফকিরী? আড়াই বছরের বাচ্চাটাও বোঝে, সে ও তার পরিবার তার স্বগোত্রীয় নাবালেগ সমাজ হতে বহু বহু বহু নিচে অবস্থান করে। তার জীবন ও জগত সেই আড়াই বছর হতেই বিষিয়ে যেতে থাকে।

সোশ্যাল মিডিয়াকে ইদানিং ভয় করতে শুরু করেছি।

সোশ্যাল মিডিয়াকে ভর করে পজিশন তৈরীর সুখস্বপ্ন যেখানে আমাদের চোখে, সেখানে সোশ্যাল মিডিয়াকে ভয় পেতে শুরু করাটা খটকা ঠেকবে বৈকি।

পজিশন না হয় হল। বিপুল জনপ্রিয় পাবলিক ফিগারও হয়তো হওয়া হল। সেই জনপ্রিয়তাকে পূঁজি করে পয়সাও হয়তো বানানো গেল।

কিন্তু, এই সোশ্যাল মিডিয়া রুচি, মানসিকতা, মনোঃস্তত্ব, চিন্তা আর ব্যক্তিত্বের যে অধঃগমন না চাইলেও প্রতিদিন ঘটাচ্ছে, সেটা রীতিমতো আতংকের বিষয় হয়ে দাড়াচ্ছে। না চাইলেও মানসিকতা অধোঃগমন করছে। মেজাজ ও চিন্তা ওভারহাইপড হতে বাধ্য হচ্ছে।

বিশেষ করে অতি উৎসাহিদের হামলা, না বুঝে না জেনে লাফানো নেটিজেনদের বাড়াবাড়ি, আর গণহারে প্রাইভেসি ইনভেশনের চাপ না চাইলেও আতংকগ্রস্থ করছে।

এই সোশ্যাল মিডিয়া যাকে মনে চায় আকাশে তুলছে। যাকে মনে চায়, যেমন করে মনে চায়, যে জন্য মনে চায় মাটিতে পুঁতছে। যাকে তুলছে বা যাকে ডোবাচ্ছে-তার আগ্রহ বা অনাগ্রহ গ্রাহ্য নেই। কে দোষী, কে দোষী নয়-তার বিচারের সামান্যতম দায়বোধও নেই। একটা লিড পেলেই হল, যে যার ধান্দায় সেটাকে টুইস্ট করছে। এই সোশ্যাল মিডিয়া ও অবাধ উদ্দাম নেটিজেনদের আদালত আপনাকে যখন যেভাবে মনে চায় উন্মাদের মতো ন্যাংটো করে ছেড়ে দেবে।

এহেন সোশ্যাল মিডিয়াকে ভয় না পেয়ে উপায় আছে? এখানে বিরাজ করে দুই চার আনা পরিচয় হয়তো বাগাতে পারব, দু’চারজনের সাথে আলাপ পরিচয়ও হয়তো হবে। কিন্তু, তার বিনিময়ে যে কোনো সময় প্রকাশ্য দিবালোকে, মানে সোশ্যাল হ্যান্ডেলে উপুর্যপরি বস্ত্রহরণ আর বলাৎকার হবার তীব্র ঝুঁকি সবসময়।

একটা সময় উন্মুক্ত জানালা ভেবে মুক্ত আকাশে বিচরনের আশা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসলেও ইদানিং ভয়ই বেশি করে। উন্মত্ত ও অশিক্ষীত জাগ্রহ জনতার ভালোবাসা ও ঘৃনার অন্যায় বলি হবার ভয়। এক সামান্য টুইস্ট করা সংবাদের ওপর ভর করে গতকাল হতে অত্যন্ত চমৎকার কয়েকজন মানুষকে যেভাবে কুৎসিতভাবে মাটিতে নামানোর চেষ্টা করেছে তথাকথিত শিক্ষিত ও অশিক্ষীত নেটিজেন নামের জাগ্রত শরিয়া জনতা, তার পরে আর হাউশ অবশিষ্ট নেই। 

ফেসবুক, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, টেলিভিশন, স্যাটেলাইট কি আমাদের তবে কানেকটিভিটি, ওয়ার্ল্ড ভিলেজ-নামের ধোঁকার ভিতর দিয়ে আমাদের ভুলে থাকা ও মেনে নেয়া দারিদ্র, অতৃপ্ত বাসনা, মানিয়ে নেয়া যাপিত জীবন-সবকিছুকে একটানে উদোম করে দিয়ে আমাদেরকে অসুখ আর ইর্ষার বহ্নিতে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে আরো আত্মপিড়নে ভুগিয়ে মারার জন্য এলো?

মিথ্যা বলায় আমরা খুব ইর্ষনীয় হারে উন্নতি করছি। সেই সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করায় আমাদের পারঙ্গমতা বাড়ছে।

মিথ্যা বলার উৎপত্তি কি হাবিল ও কাবিল হতে? নাকি ইভ কর্তৃক আপেল খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে-কেউ কি জানেন?

পবিত্র মিথ্যা নামে একটি জিনিস এক সময় শুনতাম। ধরুন, ওই যে, যুধিষ্ঠির একটি মিষ্টি মিথ্যা বলেছিলেন বলে মহাভারত বয়ান করে। আজকাল পবিত্র মিথ্যা, নোংরা মিথ্যা, কাঁচা মিথ্যা, ঠান্ডা মাথার মিথ্যা, ধান্দাবাজ মিথ্যা, বেহুদা মিথ্যা-কোনো কিছুর আর বাঁছবিচার নেই। কারনে, অকারনে আমরা মিথ্যা বলি। দরকার পড়ে না-তবু মিথ্যা বলি। পাপ হবে, অন্যায় হবে-জেনেও মিথ্যা বলি। এতো গেল ব্যক্তি চরিত্রের কথা। মাইক্রো ফেনোমেনন।

ম্যাক্রো?

জাতিগতভাবেই আমরা মিথ্যুক ও কমিটমেন্টলেস জনগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়ার থেকে কি খুব দূরে আছি? মাইক্রো নিয়েই তো ম্যাক্রো। আমাদের চারপাশ, সমাজ, রাষ্ট্র-মিথ্যার বেসাতি ছাড়া কিছু দেখেন? কমিটমেন্ট রাখার জন্য দেয়-এমন কখনো দেখেন? যেই ওয়াদা রাখব না জানি-সেই ওয়াদাও আমরা অবলিলায় অন্যের কাছে করে বসে থাকি-ব্যক্তি ও রাষ্ট্র-দু’জনে দু’জনায়। ঠিক যেন, “মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া।”

মনে হচ্ছে, ২০২১ সালে এসে মিথ্যা ও সত্য’র সংজ্ঞা ও রূপরেখা নতুন করে অভিধানে বসাতে হয় কিনা। তবু ভাল থাকুক বাংলাদেশ। #GreedyNation #nationaldestruction #socialdestruction #socialdeviation #destructivenation #socialmediadomination #socialmediamanipulation #socialmediadestruction #socialmediahype #socialmediaaholic #socialmediatrial #moralpolicing #HypocriteNation #hypocrisy #falsification #breakofcomitment #socialcompetition #frustration #illcompetition

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *