’বেতন’
নিঃসন্দেহে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য অন্যতম মেজর ওভারহেড খরচের একটি খাত। বিশেষ করে লেবার ইনটেনসিভ সেক্টরগুলোতে।
কিন্তু, একটু আউট অব বক্স ভাবলে, HRBP এপ্রোচ হতে ভাবলে ‘বেতন’ ও অন্যান্য C&B কে ’খরচ’ হিসেবে না দেখে ‘ইনভেস্টমেন্ট’ হিসেবে দেখা যায়।
কর্মীদের পেছনে যেভাবে, যে কারনে ও যা কিছু খরচ করছেন, সেটা আসলে খরচ না। এর পুরোটাই ইনভেস্টমেন্ট। আপনার বিজনেসের জন্য যেমন পুঁজি ইনভেস্ট করেন, কর্মীদের কমপেনসেশন ও বেনেফিটের টাকা আসলে তেমনই একটা ইনভেস্টমেন্ট। আপনার বিজনেস চলবার, আগে বাড়বার, টিকে থাকবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ রানিং ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট।
কর্মীরা যাতে আপনার বিজনেসের জন্য নিজেদের সবটা, নিজেদের জান, পরান উজাড় করে দেন, তার জন্য অতি তাৎপর্যপূর্ণ ইনভেস্টমেন্ট হল বেতন ও বেনেফিট।
কর্মীদের বেতন ও বেনেফিটকে খরচের বদলে বিনিয়োগ বা ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও সংস্কৃতি তৈরী হলে সেই প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের ইনক্রিমেন্ট ও ইনসেনটিভ দিতে কার্পন্য হয় না, হত না। ইনক্রিমেন্টের সময় হলে মন খারাপ হত না। এইচ.আরকে ইনক্রিমেন্টের ফাইল পাশ করাতে এত ঘাম ঝরাতে হত না। ট্রেনিংয়ের ফান্ড দিতে গরিমসি হয় না। কারন, তখন ওই টাকাটাকে আর জলে ফেলে দেয়া বলে মনে হয় না।
বেতনকে খরচ নয়, বিনিয়োগ ভাবুন। আপনার কর্মীদের খানেওয়ালা না ভেবে বানানেওয়ালা ভাবুন।
যেকোনো ব্যবসায়ীক কিংবা ব্যক্তিখাতের প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের বেতনস্কেলের আভ্যন্তরীন মানদন্ড কিংবা কাঠামো নির্ধারন একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ ড্রাইভ।
তো, এই মানদন্ড বা কাঠামো নির্ধারন ও ডিজাইনের জন্য (সম্ভবত) সবথেকে জনপ্রিয় ও প্রচলিত পন্থার একটি হল স্যালারি সার্ভে।
আরও কিছু পন্থাও ব্যবহৃত হয়। যদিও বিশাল সংখ্যক ক্ষেত্রে কোনোরকম কাঠামো, মানদন্ড ও নীতি বিদ্যমানই নেই। তাদের কথা আলাদা।
তো, মানদন্ড ও কাঠামো ডিজাইনের এই যাত্রাটিতে বাজার, কমপেটিটর, চাহিদা, যোগান, সক্ষমতা-অনেক কিছুকে বিবেচনায় রাখা হয়। তবে যে দুটি অত্যন্ত ওজনদার ফিচার বা ফ্যক্টরকে অবহেলা বা উপেক্ষা করা হয়, সে দুটি হল-
ক. বিজনেস ভায়াবিলিটি ভারসাস ডিজার্ভিং বেতনের কমপ্যটিবিলিটি কনসিডারেশন।
খ. কর্মীর বেতন নির্ধারনে অন্য ফ্যক্টরগুলোর বিপরীতে কর্মীর ইমপ্রেশন বা মোটিভেশনকে কতটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে।
প্রথমটি দিয়ে আমি বোঝাতে চাইছি, যে, কর্মীদের সলিড বেতন (বিভাগ, পদবী, র্যাংক, ওভারঅল পজিশন বিবেচনায় শ্রেনীবিন্যাসকৃত) এবং সি.টি.সি-এই ক্যালকুলেশন ও নির্ধারনের সময় ওই দুটো মোট বিজনেস এক্সপেনডিচারের কত শতাংশ, আইডিয়ালি সেটা কত শতাংশ হবার কথা, বা, বিজনেসের সার্বিক স্বাস্থ্য ও চরিত্র বিবেচনায়, মোট কত স্টেক বা প্রোপোরশনেট পারসেনটেজ হওয়া যেতে পারত, সেটা বিবেচনায় নেয়া হয় কিনা।
এটা এজন্য বলছি, কারন, হায়ারিং ড্রাইভে কাজের সময় বেতন নিয়ে আমরা প্রচন্ড রকম কনসার্নড থাকি এবং, খুব অবচেতনেই, আমাদের মাথায় সারাক্ষণ ও প্রথমেই যেটা ক্লিক করে, সেটা হল, বেতনে প্রচুর টাকা চলে যায় আর বেতনটাই খরচের বিগেস্ট স্টেক, যেটাতে নিয়ন্ত্রণ ও নিম্নমুখীতা ধরে রাখতে পারলেই বিজনেস সেফ। কিন্তু, কেউ কখনো হয়তো সায়েন্টিফিক্যালী এনালিসিসই করেনি, যে, এই বিজনেসটার বিদ্যমান স্টেটাসে সার্বিক বিচারে SBU type, Rank, Dept., Role & strategic value addition বিবেচনায় কার বেতন কত হতে পারত-লাভ-ক্ষতি ও সামর্থের চুলচেরা হিসেবের মধ্যে থেকেই। বা, ধরুন, মোটা দাগে একটা প্রোপোরশনেট পারসেনটেজ বাজেট নীতিও হতে পারত, যে, বেতনের পেছনে আমরা মোট কত পারসেন্ট এক্সপেনডিচার বরাদ্দ করলে আমরা ট্যালেন্ট ও এক্সেলেন্সে বাজারের সেরাও থাকব, আবার, বিজনেসও ফাইন্যন্সিয়ালি ভায়াবল ও গ্রোয়িং থাকবে-যাস্ট তার একটা ক্রিটিক্যাল এনালিসিস ও এক্সেকিউশন।
এটাকে বাদ রেখে বাকি সিস্টেমগুলো জারি রাখলে কাজটা হোলহার্টেড হচ্ছে না। ফলে রেজাল্টও হাফ হার্টেড হবে।
অফকোর্স, সেকেন্ড ফ্যক্টরটাও দেখতে হবে। যত গবেষনাই করুন না কেন, সেই সিদ্ধান্ত বা রিওয়ার্ড বা প্যকেজ কর্মীকে তার বেস্টটা দিতে যুগপৎ নৈতিক চাপ ও ইমোশনাল ইনসপিরেশন সাপ্লাই দিচ্ছে কিনা, সেটা নিবিড়ভাবে বিবেচনা না করলে টাকা জলে ঢালছেন। দামী গবেষনা আপনাকে নোবেলও পাইয়ে দিতে পারে, কিন্তু, তাতে রোগ সারবেই-সেটা গ্যারান্টেড হতে হবে না? মানুষ বা তার সাথে সংশ্লিষ্ট যেকোনো গবেষনায় মানুষের চিন্তা, ভাবনা, মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব, বিশ্বাস-এগুলোকে নিবিড়ভাবে যুক্ত করা অতি আবশ্যক। পিওর ফিজিক্সের মতো মিয়ারলি ল্যাব বেজড গবেষনা মানুষের গবেষনায় অচল।
মনে করা যেতে পারে, বিগত এক শতাব্দীতে এইচ.আরের দশম অবতার রূপও যদি পরিগ্রহ হয়ে থাকে, তবুও বেতন বা মজুরীকে যুগ যুগ ধরে ‘খরচ’ হিসেবে দেখবার এপ্রোচকে ‘ইনভেস্টমেন্ট’ হিসেবে দেখার চোখে রূপান্তর বা বিবর্তন খুব কমই হয়েছে। আর বেতন বা CTC কে ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে দেখতে না শিখলে বাদবাকি গবেষনা ও আমার টেক্সটহ্যাভি স্টেটাস প্রসব-সবই বেহুদা।
বেতনের পরিমাণ ও ধরনের ওপর ভিত্তি করে বেতনের স্তরগুলো এই ফাঁকে একবার দেখে নিই-
১. Minimum Wage-সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন মজুরি
২. Statutory Wage-সরকার, আইন বা চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত মজুরি
৩. Fair Wage-কাজের nature, দক্ষতা, দায়িত্ব, কোম্পানির সক্ষমতা এবং বাজারদরের ভিত্তিতে ন্যায্য মজুরি
৪. Living Wage-একজন কর্মী ও তার পরিবারের মানবিকভাবে জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত মজুরি, যেখানে খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও সঞ্চয় অন্তর্ভুক্ত থাকে
৫. Prevailing Wage-নির্দিষ্ট অঞ্চলে ও নির্দিষ্ট পেশায় প্রচলিত বাজারদর
৬. Basic Wage (Basic Salary)-মজুরির মূল অংশ, যার ভিত্তিতে Allowance, Bonus, PF, Gratuity হিসাব হয়
৭. Nominal Wage (Money Wage)-কোনো শ্রমিকের প্রদত্ত মজুরির অর্থমূল্য
৮. Real Wage-মজুরির ক্রয়ক্ষমতা অর্থাৎ, Tk 15,000 দিয়ে ঠিক কী পরিমাণ পণ্য/সেবা কেনা যায় তা Real Wage নির্দেশ করে।
৯. Need-Based Wage-Living Wage-এর কাছাকাছি। কর্মীর মৌলিক ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা পূরণে যথেষ্ট মজুরি।
১০. Family Wage-এমন মজুরি যা একজন কর্মীর পুরো পরিবারের খরচ বহন করতে পারে। Living Wage-এর social extension হিসেবেই ধরা যায়।
১১. Subsistence Wage-বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মজুরি, যেখানে কেবল খাদ্য, কাপড় ও আশ্রয় থাকে, কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা সঞ্চয় নেই।
নিজ নিজ বেতন নিয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট-এমন চাকরিজীবি খুব বিরল। যে যতটা পান, মনে করেন, তার আরও পাবার কথা। সরকারী চাকরির কথা বাদ দিলাম। সরকারী নিয়ম-কানুন নিয়ে কথা বলার নাগরিক অধিকার গণতান্ত্রীক রাষ্ট্রে হারাম।
কথা বলছি বেসরকারী চাকরির বেতন নির্ধারন নিয়ে। বিশেষ করে, কর্পোরেটে একজন নবাগত (ফ্রেশার) প্রার্থীর প্রারম্ভিক বেতন কত হওয়া উচিত-তা নিয়ে বিতর্কের ইয়ত্তা নেই। চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ, নিয়োগদাতারা ভাত ছড়িয়ে কাক ধরতে চান, পারলে বিনা পয়সায় খাটিয়ে নিতে চান। আবার নিয়োগকর্তা বা তার প্রতিনিধিত্বকারী এইচআর কর্মীরা মনে করেন, তারা (তাদের ভাষ্য মতে) যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ন্যায্য বেতনই দিয়ে থাকেন এবং প্রার্থী তার চেয়ে বেশী প্রাপ্য (ডিজার্ভ) করেন না। যদিও কোনো স্বাধীন জরিপ এই নিয়ে হয়নি।
তবু চারপাশের সাম্প্রতিক জানাশোনা যাঁচাই করলে মোটামুটি একটি ধারনা পাওয়া যায়, যে, নবাগত (ফ্রেশার)দের বেতন কমপক্ষে ২০ হাজার হওয়া উচিত বলে মনে করেন অধিকাংশ নবাগত প্রার্থীরা। (যারা ৫০ হাজার বলে মনে করেন, তাদের কামনার ব্যখ্যা আমার কাছে নেই, দুঃখিত)। আর কিছু কিছু অত্যন্ত উচ্চস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বাদে বেশিরভাগ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে (যারা মধ্যম সারীর) নবাগতদের বেতন কমবেশী ১২ থেকে ১৬ এর মধ্যে ওঠানামা করে। হ্যা, অবস্থান, অবস্থা ও যোগ্যতা ভেদে সেটা কখনো কখনো ১০ হাজারের কাছেও যাবার নজির আছে।
আজকের লেখা বেতনের সর্বজনগ্রাহ্য পরিমান নির্ধারন নয়। একটি সর্বজনগ্রাহ্য বেতন সীমা নির্ধারন এত সহজ কাজ নয়। আজকের আলোকপাত, বেতন নির্ধারনের প্রক্রিয়া নিয়ে। যাতে সংশ্লিষ্ট সবার কিছুটা হলেও ধারনা জন্মে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে আর দূর হয় অহেতুক জটিলতা ও ক্ষোভ। কীভাবে একটি চাকরির বেতন নির্ধারিত হয়? কী কী নির্নায়ক/পরিমাপক (ফ্যাক্টর) সেখানে বিবেচীত হয়? কয়েকটা বলি-
১. প্রতিষ্ঠানের সার্বিক আর্থিক সামর্থ, বিভিন্ন বিভাগ ও পদের ‘ভ্যালু রেটিং’।
২. প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’, কর্পোরেট চরিত্র, ক্ষেত্র (সেক্টর) ও সংস্কৃতি।
৩. প্রতিষ্ঠানটির এইচআরের চরিত্র ও সক্ষমতা।
৪. পেশাজীবি বাজারে ওই অবস্থানটির চাহিদা ও তার বিপরীতে যোগানের ভারসাম্য।
৫. প্রতিষ্ঠানটিতে ওই মুহূর্তে ওই পদটির ‘ভাইটালিটি’ ও ‘আর্জেন্সী’।
৬. বেতন বাদে প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য আর্থিক ও অনার্থিক সুযোগ সুবিধা।
৭. প্রার্থীর প্রদর্শিত ব্যক্তিগত যোগ্যতা>তাত্বিক শিক্ষাগত, কৌশলগত দক্ষতা এবং সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা।
৮. নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে নিরূপিত প্রার্থীর মূল্য সংযোজন বা মূল্য সৃষ্টির সম্ভাবনা ও তার সংখ্যাগত ধারনা।
৯. দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থান, যার ভিতর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে>মুদ্রাস্ফিতি, মূল্যস্তর, জীবনযাপনের ব্যয় ও ধরন, জিডিপির আকার ও প্রবৃদ্ধি।
১০. সরকারী চাকরির তুলনামূলক প্রতিযোগীতা ও আপেক্ষিক চাপ।
১১. চাকরির বাজারের আকার, সুযোগ, সার্বিক সংস্কৃতি।
১২. দেশের পেশাজীবি ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সার্বিক ভূমিকা ও প্রভাব।
১৩. ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান।
সবচেয়ে বড় কথা হল, বেসরকারী চাকরির বাজারে বেতনের স্তর ও কাঠামো নির্ধারিত হয় বাজার শক্তি বা মার্কেট ফোর্স দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এখানে সুশীল নীতি ও দেশপ্রেমের ভূমিকা অতি নগন্য। আপনিই বলুন, আপনি যখন বাসার কাজের বুয়াকে নিয়োগ দেন, তখন কি চেষ্টা করেন না, সবচেয়ে কম বেতনে কাকে পাওয়া যায়? আপনার জুতা মর্দন (পলিস) করার সময় পর্যন্ত আপনি দুই দোকান যাঁচাই করে নেন, কে কম নেবে। দুইটা টাকা কম পেলেই আপনি টুক করে সেখানে চলে যান। তাহলে নিজেই ভাবুন, আপনি কি বাজার শক্তি (মার্কেট ফোর্স) দ্বারা তাড়িত নন?
আর যদি আপনি বলেন, কেন, দেশে পুরো বেসরকারী খাতে একটি ন্যুনতম কাঠামো হতে পারে না? ভাই, আপনি বাংলাদেশে বাস করে একটি সার্বজনীন বেসরকারী বেতন কাঠামোর স্বপ্ন দেখছেন? আর এর বাইরে বাংলাদেশে বড় সংখ্যক স্থানে কয়েকটি অপ্রচলিত সূত্রও কাজ করে-প্রার্থীর জাতীয়তা, সুপারিশ, আগের বেতন এরকম কিছু বিষয়। আগের চাকরির বেতন যদিও নতুন প্রতিষ্ঠানের বিবেচ্য বিষয় হওয়া খুব একটা ’কস্ট ইফেকটিভ’ নয়, তবু এটার চর্চা অনেকই হয়।কী ভাবছেন? আপনাকে চাকরির প্রস্তাব দেয়া আর দর কষাকষির সময় এইচআরের কর্তা বা প্রতিষ্ঠান মালিকরা এত এত সব জটিল জিনিস ক্যালকুলেটরে মেপে মেপে, এই পরিমাপকগুলো একটি একটি করে কঠিন হিসেব নিকেষ করে তারপর আপনাকে বেতন প্রস্তাব করে?
না। তা মোটেই করেন না। তবে হ্যা, সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়া সম্পর্কে যদি আপনার ভাল ধারনা থেকে থাকে, তাহলে আপনি নিশ্চই জানবেন, সিদ্ধান্ত গ্রহন যিনি করেন, তিনি বা তারা অবচেতনেই সিদ্ধান্ত গ্রহনের একটি প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যান। যেখানে ওই সিদ্ধান্তের সাথে সংশ্লিষ্ট সবগুলো বা অধিকাংশ নিয়ামকই ওই ব্যক্তির চিন্তার ভিতরে অবচেতনভাবেই প্রভাব বিস্তার করে। যা কখনো তিনি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ (প্রার্থীসহ) অনুধাবন করতেও পারেন, কখনো কখনও বা দীর্ঘ অভ্যস্ততার কারনে নাও পারেন।
সামাজিক মাধ্যমে, বিশেষত ফেসবুক নামক ভাগাড়ে প্রায়ই একটি খুব সাধারন (কমোন) আহাজারি ধ্বনিত হতে দেখি, “”একজন রিক্সাওয়ালার মাসিক আয় যেখানে ৩০ হাজার টাকা, একজন ‘*অশিক্ষিত’ গারমেন্টস ওয়ার্কারের মাসিক বেতন যদি হয় ১৫ হাজার, একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতার মাসিক আয় যখন ৫০ হাজার টাকা; তখন একজন MBA ধারী ‘*শিক্ষিত’ ফ্রেশারের বেতন কীভাবে ৮/১২ হাজার টাকা অফার করা হয়?” দেখার বিষয়, এখানে MBA এর তুলনাটি যাদের সাথে হচ্ছে, তারা সবাই স্কিলড, experienced এবং তাদের ভ্যালু প্রপোজিশনটি প্রোভেন।
MBA ধারী fresher, তার স্কিল থাকতেও পারে, তবে তা এখুনি নিশ্চিত, প্রমানিত বা সুপার রেলেটেবল নয়। ভবিষ্যতে সে অবশ্যই (সব ঠিক চললে) ভ্যালু এ্যডেড হবার কথা। তাহলে, বর্তমানের এই অনুযোগটি কি একাডেমিক ডিগ্রীকে স্কিল, experience ও ভ্যালু প্রপোজিশনের ওপর সুপ্রিমেসি দেবার দাবী করছে? মানে, ডিগ্রীধারী যাই হোন, তার আয় *অশিক্ষিত কিন্তু স্কিলড লোকের চেয়ে কম দেয়াটা অন্যায্য? কর্মক্ষেত্রে একাডেমিক ডিগ্রী কি রেলেভেন্ট কমপিটেন্সির চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাবার ন্যায্য ও অবশ্যম্ভাবি দাবীদার?
এই ধারনার জন্ম শৈশব হতে। আমাদের মাথার ভেতর প্রোথিত করে দেয়া হয়েছে, লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে। মানে, উন্নত জীবন, উচ্চ আয়, হায়ার স্টেটাস কেবল শিক্ষার বিনিময়ে পাওয়া যাবে। অথবা, ওগুলো পেতে হলে শিক্ষা লাগবে। সে কারনে, ডিগ্রীধারীরা এই প্রত্যাশা বুকে নিয়েই শিক্ষায়তনে যান, যে, একটা ভাল জীবন পাব, অন্যদের চেয়ে বেশি পাব। দেখবেন, কথায় কথায় আমাদের বাবা-মায়েরা বলতেন, পড়াশোনায় ভাল না করলে কিন্তু রিক্সা চালিয়ে খেতে হবে। মানে, ডিগ্রী অর্জন করে পাওয়া জীবনের চেয়ে বাই ডিফল্ট রিক্সা চালিয়ে জীবন চালানো ডিসগ্রেসফুল। তখন হতেই, ডিগ্রী অর্জনের মধ্য দিয়ে আমরা ডিফল্ট প্রায়োরিটাইজড হব-সেই প্রত্যাশা মনে নিয়েই পড়াশোনা করি সবাই। সেজন্যই গায়ে খাটাদের বেশি আয় আমরা মেন্টালি মানতে পারি না। তুলনা দিতে হলে সবার আগে তাদের সাথে দিই। যারা কাজের বুয়ার বেতন হতে এম.বি.এ হোল্ডারের বেতন বেশি হবার সমর্থক, তারা ডিগ্রীকে একটা প্রাইড ফ্যক্টর হিসেবে দেখেন। কিন্তু, সত্য হল, শিক্ষা অর্জনের মূখ্য উদ্দেশ্য অর্থ, বিত্ত, আরাম একদমই নয়। ওগুলো শিক্ষার বাই-প্রডাক্ট মাত্র। শিক্ষার উদ্দেশ্যই যেখানে রং, সেখানে পাবলিক পারসেপশন ঠিক হবার কারন নেই।
হোয়াইটকলাররা ক্ষোভ ঝাড়েন, ”এর চেয়ে মাটি কাটাও ভাল।” ভাইয়েরা, মাটি একদিন কেটে দেখুন, তারপর এই কথা বলুন।
”সারাজীবন এত লেখাপড়া করে, ডিগ্রী নিয়ে, শিক্ষিত হয়ে, বিদ্যা হাসিল করে কী লাভটা হল? একটা ’অডিনডি’ও তো কিনতে পারলাম না। অথচ আউলফাউল কাম কইরা কতজনে দামী দামী ‘ভাইডি’, ‘মারচিডিজ’ কিনা হালাইল।”
বলে আফসোসে মরে যাওয়া ভাইজান ও বুবুজানরা আসলেই এই আফসোসে মরাটা ডিজার্ভ করেন। কারন, তাদের শিক্ষা ও বিদ্যা আসলে পুরোটা জলেই গেছে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য বা মোটোটা না জেনেবুঝেই তারা সার্টিফিকেটটা অর্জনের পেছনে জীবনটা বোকার মতো বরবাদ করে ফেলেছেন।
যে কোনো কাজ করতে প্রস্তুত থাকা আর যেকোনো কাজকে সম্মানের সাথে দেখার একটা আহবান আমরা প্রায়শই উচ্চারিত হতে শুনি। সব পেশাকেই সম্মানের সাথে দেখা, কোনো কাজকে ছোট মনে না করবার জোরদার প্রচারনা আমরা করি। আমিও করি।
কিন্তু, কখনো কি ভেবে দেখেছি, যে, এই “যে কোনো পেশাকেই সম্মানের সাথে দেখা ও সমান ট্রিটমেন্ট দেয়া”র তিনটি ভিন্ন ডাইমেনশন আছে?
ক. যে কাজটি করবে (কর্তা)
খ. যে বা যারা তাকে কাজটি করতে দেখবে (আমজনতা ও পরিবার)
গ. যে তাকে কাজটি করাবে (নিয়োগদাতা)
আমরা যখন “কোনো কাজই ছোট না”-জিনিসটার মহানত্ব নিয়ে এ্যডভোকেসি করি, তখন জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারেই আমরা মূখ্যত কাজটি যে করবে-তাকেই বলি, যে, সব কাজ করতে যেন সে প্রস্তুত থাকে। হ্যা, কিছুটা অবচেতনে আমরা সমাজ ও আমজনতাকেও বলি, সব কাজকে যেন তারা সমান স্বীকৃতি দেন ও সম্মান করেন। (যদিও যে বা যারা এই আহবান জানাই, বা যারা মি. ওবামার মেয়ে শাশার রেস্তোরাঁয় কাজ করাকে মহিয়ান বলে মুখে ফেনা তুলি, তারা নিজেরাও রিক্সাওয়ালা কিংবা মাছ কাটারির মেয়েকে বিয়ে করতে প্রস্তুত না।)
কিন্তু, কখনোই যেটা করি না, তা হল, যে কাজটা করাবে, মানে নিয়োগদাতা, সে যেন তার সব স্তরের কর্মীকেই সমান চোখে দেখে, সমান সম্মান ও ট্রিটমেন্ট দেয়, সেটা কখনো বলি না। নিয়োগদাতা যেন তার পিওন, মেথর হতে CEO সবাইকে সমান চোখে দেখে-সেটা করতে বলি না। আর সেটা যতদিন না হচ্ছে, মানে, যতদিন নিয়োগকর্তা তার প্রতিষ্ঠানের মেথর ও CEO কে সমান ট্রিটমেন্ট ও রিকগনিশন দিতে না পারবেন, ততদিন সবাই সব কাজ করতে প্রস্তুত হবে না। সমাজও সব কাজের কাজিকে সমান সম্মান, সমীহ ও গুরুত্ব দেবে না। আর সমাজ ও পরিবার যতক্ষণ না সব কাজ ও পেশাকে সমান রেসপেক্ট, স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দিতে না শিখবে, ততদিন চাকরিপ্রত্যাশী অথবা চাকরিজীবি-কারোর পক্ষেই যেকোনো কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে না। ঠেকায় পড়ে করলেও সেটাকে ভালোবাসা ও মাথা উঁচু করে সেটাকে ওউন করা তাদের জন্য সম্ভব হবে না।
কারন, শিক্ষা, শিক্ষাক্রম, জ্ঞান ও বিদ্যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য টাকা আয় করা না। টাকা এনে দেয়া না। শিক্ষার কাজ মনুষ্যত্ব ও বোধ তৈরী করা। সেই লক্ষ্যের বাই-প্রোডাক্ট হল কিছু লাইফ স্কিল, যা টাকা এনে দিতে পারে। তার মানে এই না, যে, বেশি বেশি ও উচ্চ রেজাল্টধারী লেখাপড়া শিখলে আনুপাতিক হারে প্রচুর টাকা আসবেই।
লেখাপড়া না করে হিপহপ, টিকটক, ডিগডগ করলেই ভাল হত-বলে যদি বেশি আফসোস হয়, তাহলে আর টিকটক কেন? তার চেয়ে আরও লাভজনক, আয়জনক কাজ আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
আমেরিকার Reality তারকা মিজ. Stephanie Matto আক্ষরিক অর্থে তার **পাঁদ জারে ভরে বিক্রী করে দেড় কোটি টাকা কামাই করেন। টাকা ও সম্পত্তি আয় নিয়ে এতই আফসোস থাকলে, বিদ্যা জলে যাওয়া নিয়ে এতই আফসোস থাকলে লেখাপড়া বাদ দিয়ে ওই কাজ করুন।
অস্ট্রেলিয়া বা নেদারল্যান্ডসে কিছু ব্রোথেল আছে, যেখানে শুয়ে ঘন্টায় ৩০০ হতে ৫০০ ডলার কামাই করা যায়। মানে অবিশ্বাস্য রকম ইনকাম। টাকাই যদি লক্ষ্য ও আফসোস হয়, তাহলে লেখাপড়া না শিখে *পাঁদ বা *পোঁদ বিক্রী করলেই বরং ভাল। অনেক ইনকাম।
লেখাপড়া করে স্কুল শিক্ষক হয়ে মাসে ৫৮৭০ টাকা কামাই করে কী হবে? জীবনেও একটা ‘ঘাঁড়ি’ কিনতে পারবেন না।
*অনার্য ভাষাশৈলী সৃষ্টিকর্মের স্বার্থে। ইহা লেখকের নিয়মিত রুচি নহে।
প্রথমেই ভেবে দেখুন, এই কথা দিয়ে কি ওই শ্রমজীবি ও স্ব-নিয়োজিত (সেলফ এমপ্লয়েড) কর্মীদেরকে ও তাদের শ্রমকে অবজ্ঞা করা হয় না? এটা বলা হয় না, যে, এম.বি.এ ধারীর বেতন হতে হবে ন্যুনতম রিক্সাওয়ালার বেতনের সমান বা বেশি? কেন ভাই, একজন রিক্সাওয়ালা কী দোষ করলেন আর আপনি কী এমন পূণ্য অর্জন করলেন, যে, তিনি আপনার চেয়ে বেশি আয় করলে সেটা পাপ হবে? আয় ও বেতন নির্ধারকের নিয়ামক কি স্রেফ এম.বি.এ ডিগ্রী? আর কিছু না? আর আপনি যদি মনে করেই থাকেন, রিক্সাওলার ২০ হাজার টাকাটা আপনার এমবিএর ৮ হাজারের চেয়ে বেশি, তাহলে আপনি হয়ে যান না রিক্সাওলা। আপনিই তো বলেন, কোনো কাজই ছোট নয়।
খুব কাছের উদাহরন আরেকবার দিই। মিনিমাম ওয়েজ রিভিউয়ের সময়টা এলেই, একটি বিষয় খুব জোরেসোরে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। হ্যা, সারাবছরই আলোচনাটা চলমান থাকে, তবে ততোটা জোরালো বা সরগরম আকারে নয়।
তর্কের বা আলোচনার ফোকাসটি হল-
মিনিমাম ওয়েজ বাস্তবায়নের পরে/ফলে (বিশেষত এবার ২০২৩ এ), সর্বোচ্চ ধাপে থাকা একজন দক্ষ শ্রমিক বা ওয়ার্কার (আসলে কর্মী) এর বেতন দাড়াতে পারে ১৪,৭৫০ টাকা, যা ওভারটাইম ও আরও কিছু আয় যুক্ত হলে দাড়াবে মাসিক আয় আনুমানিক ১৮,০০০-১৯,০০০ টাকায়।
এখন, আমাদের অনেকেরই গ্রীভ্যান্স বা দুশ্চিন্তা দাড়িয়েছে যেটা, তা হল,
”একটা অশিক্ষিত গারমেন শোরমিকের ব্যতন যদি ১৯ হাজার টাকা অয়”, তাহলে একজন ফ্রেশার অথবা স্বল্প অভিজ্ঞ ও নিচের দিককার জুনিয়র অফিসারের ন্যুনতম বেতন কত হওয়া উচিত?” প্রশ্ন করলেও উত্তরটাও প্রকাশিত, সেটা হল, এনাদের মিনিমাম বেতন অবশ্যই অবশ্যই ওই সর্বোচ্চ ধাপের শ্রমিকের বেতন হতে বেশিই হতে হবে।
কারণ? কারণ, তারা স্টাফ, তারা হোয়াইট কলার, তারা শিক্ষিত, তারা বস, তারা সুপারভাইজার, তারা সুপেরিয়র, তারা আপারহ্যান্ড, তারা উঁচু। (বিদ্যমান ন্যারেটিভের আলোকে বললাম।) এই আলোচনা কেবলমাত্র RMG সেক্টরের ক্ষেত্রেই-তা ভাবলে ভুল হবে। সব সেক্টরেই এখন তুলনাটি ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। এই গতকালও সেই প্রশ্নটি আমি তুলে ধরেছিলাম-”শ্রমিকের আয় ১৯ হাজার হলে এম.বি.এ ধারীর বেতন কী করে ১২ হাজার হয়?” এখন প্রশ্ন হল, শ্রমিকের (আসলে কর্মীর) বেতন হতে স্টাফের বেতন অবশ্যই ওপরে থাকতে হবে, বা, ব্লু কলার কর্মীর বেতনের চেয়ে হোয়াইট কলারের বেতন কম হতে পারবে না, বেশি শুধু না, ভাল রকম বেশি হতে হবে-এই জনদাবী কতটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত?
আমি কোনো ন্যারেটিভ বলছি না। আলোচনাটি উন্মুক্ত রাখছি। সবার মতামতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে।
কে বলেছে আপনাকে এম.বি.এ করতে? কাজের কথা বলি। ড্রাইভার, রিক্সাওয়ালা বা একজন চটপটি বিক্রেতার বেতন বা আয়ের সাথে একজন কর্পোরেট চাকরিজীবির বেতনের তুলনা করাটাই একটি চরম ভুল। সেই ভুলের কোনো যৌক্তিকতা বিচার করা তাই অহেতুক। সারা পৃথিবীতেই স্ব-নিয়োজিত (সেলফ এমপ্লয়েড) মানুষেরা গড়পড়তা নিচের দিকের চাকরিজীবিদের চেয়ে বেশি আয় করেন। আমার দেখা অনেক চটপটি বিক্রেতা কিংবা সবজি বিক্রেতার বাড়িতে তিনতলা বাড়ি আছে। তাই বলে তো আর চাকরিজীবিরা চাকরি বাদ দিয়ে রিক্সাওয়ালা হয়ে যান না। চাকরি আর রিক্সাওলার তুলনা করাটা যেন টাইটানিকের সাথে টাটা ট্রাকের তুলনা হয়ে যায়।
বিকল্প বা নন-কনভেনশনাল পেশার সম্ভাবনা, আয়, পসার, সামাজিক স্বীকৃতি, ইদানিংকার অস্বাভাবিক রকম আয়বৃদ্ধি-এসব নিয়ে যখন আলোচনা করছিই, তখন বহু আগের একটা অভিজ্ঞতা না বললেই নয়।
স্থান: ঢাকার লোকাল বাস; কাল: অদ্য সন্ধ্যা; পাত্রপাত্রী: আমি, নিটোল ও জনৈক প্যাটিসওলা; দর্শক: লোকাল বাসের আমজনতা;
ঘটনাক্রম: সন্ধ্যায় গিন্নী নিটোলকে নিয়ে গিয়েছি আসাদগেট। জরুরী একটা কাজে। ফেরার সময় বৃষ্টি। কোনমতে দৌড়ে মিয়া বিবি উঠে পড়ি একটা লোকাল বাসে। কায়ক্লেশে দুটো সিট ম্যানেজ হওয়ায় খোদাকে ধন্যবাদ দিই। একটু থিতু হয়ে বসার পরে সামনে খেয়াল করে দেখি একজন প্যাটিসওয়ালা তার বক্স নিয়ে বসেছেন। বাঙালী মাত্রই সহযাত্রীর সাথে খোশ আলাপে মজে। আমি এমনিতেই মানুষের পেশা নিয়ে সবসময় আগ্রহী। প্যাটিসওয়ালার সাথে আলাপ জমাতে তার কাছে তার কাজের খোঁজখবর নিলাম। যা জানলাম তাতে শ্রদ্ধা আর সমীহবোধ জাগল মানুষের ঐকান্তিকতা, চেষ্টা, অধ্যবসায়, শ্রম ও সততার প্রতি। ভদ্রলোক (প্যাটিসওলাদের কেউ ভদ্রলোক বলেন না বোধহয়) প্রতিদিন দারুস সালাম কারখানা হতে মালিকের কাছ থেকে এক টিন প্যাটিস কেনেন। টিনে ধরে ২০০ পিস। ১০-১৫-২০ টাকা-তিন রকমের প্যাটিস থাকে। তার মানে কমপক্ষে ২০০ পিস/২০০০ টাকার প্যাটিস তিনি বিক্রি করেন।
প্রায় সবদিনই বিক্রী হয়ে যায়। যতটা তিনি বললেন, তাতে জানলাম ১০ টাকার প্যাটিস তিনি কেনেন ৩-৪ টাকা করে মালিকের কাছ থেকে। বাকিটা তার। তার মানে প্রতিদিন ২০০ পিস বিক্রী করলে তার মার্জিন থাকে ৭ X ২০০ = ১৪০০ যেটা তার নিজের। তার থেকে বাদ যাবে তার যাতায়াত খরচ আর দুপুরের/বিকেলের খাওয়া দাওয়া, চা, পানি, সিগারেট, পান ইত্যাদি। যাহোক, ধরে নেয়া যায় প্রতিদিন কমপক্ষে তার নেট মুনাফা ১২০০ কমপক্ষে। আর তিনি মাসে ২৫ দিন কাজ করেন।
মানে দাড়াল, তার মাসে ন্যুনতম আয় ৩০,০০০ টাকা যেটা আসলে ৩৫-৪০ হাজার হবে। কারন বেশি দামের প্যাটিসও থাকে।
ভদ্রলোককে আমি জিজ্ঞেস করি, তিনি গ্রাম হতে এসে এই বুদ্ধি বা সুযোগ কীভাবে পেলেন। তিনি হেসে জবাব দেন, “ঠ্যাকা ভাইজান, ঠ্যাকা।” আমিও তাই ভাবি। ঠ্যাকা মানুষকে কতকিছু করতে শেখায়। কত কী ভাবতে, আবিষ্কার করায়। তা না হলে একজন অশিক্ষিত মানুষ, শহরে এসে নিজের মতো করে স্বাধীন ব্যবসা করছেন। আর আমরা বিএ/এমএ পাশ করে চাকরীর পেছনে হত্যে দিয়ে মরি। কোট টাই পড়া চাকরীর পেছনে ঘুরে মরি, সারাজীবন কেঁচোর মতো বাঁচি। অথচ এইসব অশিক্ষিত অথচ উদ্যমী উদ্যোগী মানুষেরা নিজের চেষ্টায় নিজের স্বাধীন পেশা বেছে দারুনভাবে জীবন চালাচ্ছেন। আয় রোজগারও বেশি।
একজন এম এ পাশ মানুষ বর্তমান বাংলাদেশে খুব ব্যাতিক্রমী কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া শুরুতে অনেকদিন ওই আয়ের ধারেকাছেও বেতন পান না। তাই বলে ভাববেন না, আমি পড়াশোনাকে অনুৎসাহিত করছি। আমি পেশার ডাইভারসিফিকেশন ও যেকোনো পেশাকে সম্মান ও সুযোগ হিসেবে নেবার বিষয়টাকে দেখাচ্ছি।
বিষয়টাকে সুসংবাদ বা দুঃসংবাদ যেভাবেই নিন নিতে পারেন। খবরটা হল, বাংলাদেশে প্রথাগত বা কনভেনশনাল চাকরীর থেকে, অপ্রচলিত বা ননকনভেনশনাল কাজের আনুপাতিক নেট ইনকাম দিন দিন বাড়ছে। অনেকক্ষেত্রে তা বেশিও।
বিশ্বাস না হলে, একজন চা বিক্রেতার প্রতিদিন বা প্রতিমাসের আয়ের হিসাব নিন। একজন মুচি বা বুয়ার মাসিক ইনকাম কত জানেন? ওহ, কম মনে হচ্ছে? তাহলে গড়পড়তা একজন এমএ পাশ সাহেবের প্রথম তিন বছরের গড় বেতনের হিসাব নিন।
ফ্রাস্ট্রেশন. টেনশন. ভয় কাটিয়ে উঠবার জন্য অন্যতম কার্যকর মাধ্যম হল নিজেকে প্রশ্ন করা-
”তুমি কী চাও?”
“তুমি তা কেন চাও?”
”তুমি তা কীভাবে চাও?”
একবার একটি জাহাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মালিক অনেক চেষ্টা করছিলেন রাজ্যে কেউ আছে কি না যে তার জাহাজ ঠিক করে দিতে পারে।
অনেকেই আসে যায়। কিন্তু কেউই জাহাজ ঠিক করতে পারে না। অবশেষে একদিন এক লোক এল। তার কাছে ছিল একটি টুলবক্স। সে বেশ কিছুক্ষণ জাহাজের পার্টসগুলো পরীক্ষা করল। ইঞ্জিনের কাছে গিয়ে সে তার বক্স থেকে একটা হ্যামার বের করল ও তিনটি বাড়ি দিল। আশ্চর্যজনকভাবে জাহাজটি ঠিক হয়ে গেল। বিকল ইঞ্জিন সচল হয়ে গেল।
মালিক মহাখুশি। মালিক তার ওয়াদা অনুযায়ী এবার লোকটিকে পুরস্কৃত করবে। লোকটিকে বিল পাঠাতে বলা হল। লোকটা বিল পাঠাল এক লাখ টাকা।
বিল দেখে জাহাজের মালিকের মাথায় হাত। এত টাকা বিল কেন, তুমি তো কেবল জাহাজে তিনটি বাড়ি মেরেছ, তার জন্য কেন এত টাকা চাইছ। তুমি আমাকে ভেঙে ভেঙে দাম বলত।
তখন লোকটি বলল, বাড়ি ৩টা মারার জন্য আমি আসলে ৩০০ টাকা চার্জ করেছি, আর বাড়ি ৩টা ঠিক কোথায় মারতে হবে সেটার এ্যকিউরেসি, যেটা অর্জন করতে প্রায় ২৫ বছর লেগেছে, তার জন্য চার্জ করেছি আর ৯৯,৭০০ টাকা।
এই অস্বাভাবিক রকম বাড়তি টাকাটা আমার গত ২৫ টি বছর, এ্যকিউরেসি ও নলেজের দাম।
এম.বি.এ ধারীদের বেতনস্কেল নিয়ে এরপরও ক্ষোভ বা জানবার থাকলে জনাব Md Rashedul Islam সাহেবের এই ব্যাখ্যাটি একবার পড়ে দেখবেন:
[আমার অফিসের সামনে ফুটপাতের চায়ের দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম মাসে কত ইনকাম হয়। কনফিডেন্সের সহিত উত্তর দিল এখন ব্যবসা একটু খারাপ তাই মাসশেষে ৬০-৭০ হাজার টাকা থাকে। ওদিকে ফুডআপ্পি চুটকিতেই মাসে দশ লাখ কামাচ্ছে। রড সিমেন্টের ব্যবসা করে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে সিগনেচার করতে না পারা লোকজন। এসব দেখে, কঠোর প্রতিযোগিতার পার করে ২২০০০ টাকা স্কেলে সরকারি চাকরি পাওয়া কিংবা বুয়েট মেডিকেল থেকে পাশ করে দীর্ঘ অর্থনৈতিক মন্দায় সময় পার করাটা হতাশাজনক মনে হতেই পারে।
এমন বাস্তবতায় শুধু বাংলাদেশকে দোষারোপ করে লাভ নেই, ঘটনা সবদেশে একই। নিউইয়র্কে ফুলটাইম উবার চালালে আইভি লীগ থেকে মাস্টার্স পাশ গ্র্যাজুয়েটের চেয়েও বেশি ইনকাম করতে পারবেন। ডিভি লটারিতে আমেরিকা এসে সুপার শপের ব্যবসা দাড় করায়ে একটি পিএইচডি ও দুটো পোস্টডক করা লোকদের চেয়ে অনেকগুন বেশি টাকা কামাতে পারবেন। পড়ালেখা ও উচ্চশিক্ষা উপার্জনের সমানুপাতিক নয়। কারো লক্ষ্য যদি শুধু টাকা উপার্জনই হয় তাহলে বলব পড়ালেখা কোন জরুরি বিষয় নয় বরং খুব আর্লি প্ল্যান করে অন্য কোন কিছু করার ট্রাই করুন। পড়ালেখাকে প্রায়োরিটি লিস্ট থেকে বাদ দিন কিংবা শেষের দিকে রাখুন। অঢেল টাকা উপার্জনের চিন্তা মাথায় রেখে শিক্ষা অর্জন করতে গেলে শুধু হতাশাই আসবে।] #career #salaryrange #salarynegotiation #salaryfixation #properremuneration #wagecalculation #smartpay #paymentfixation #salaryestimation #salarystructure #standardsalary #whitecollarsalary #MBAholdersalary #efficiency #intelligence #wisdom #careerthinking #unconventionalcareer