Skip to content

বিগশট, জায়ান্ট, আইডল, আইকন, গুরুদের নিয়ে রচনামৃত:

জব সেক্টরে সিনিয়রদের দায়বদ্ধতা:
(ক তে ক্যারিয়ার-কেন্দ্রবিন্দু-বইমেলা ২০২৪ এ প্রকাশিত।)

নতুনদেরকে/জব সিকারদের সিনিয়ররা কীভাবে সাহায্য করতে পারেন?

বাংলাদেশে ২৬ লাখ বেকার।

১৭ কোটি জনসংখ্যা হলে এটা মোট মানুষের প্রায় ১০ শতাংশ।

পাশাপাশি সীমিত কর্মসংস্থান, অস্থির জব মার্কেট আর বেড়ে চলা প্রতিযোগীতার কারনে প্রতিনিয়তই জব মার্কেটে নাম লেখাচ্ছেন চাকুরীরত বা চাকুরীচ্যুত জুনিয়র, মধ্যম ও সিনিয়র মোস্ট কর্মীরা। এর সঙ্গে রয়েছে বিপুল সংখ্যক ফ্রেশার প্রার্থী প্রতিবছর যারা প্রায় ৭ লাখ যুক্ত হচ্ছেন জব মার্কেটে।

এই বিপুল সংখ্যক মানুষের বিপরীতে প্রতিবছর চাকরী সৃষ্টি হচ্ছে বা খালি হচ্ছে খুব সামান্য। তার উপরে বিগত কয়েক বছরে প্রাইভেট সেক্টরে জব সিকিউরিটি ও ক্যারিয়ার ইনস্ট্যাবিলিটির কারনে মানুষের ভিতরে জব বদলাবার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। সবমিলিয়ে জব সেক্টরের অবস্থা খুব টালমাটাল। এই মানুষেরা নিজেদের মতো করে নানা মাধ্যমে চেষ্টা করছেন নিজেদের ক্যারিয়ার সাসটেইন করতে, এগোতে। বিশেষত ফ্রেশাররা আছেন সবচেয়ে বড় বিপদে।

জাতীয় ভুল শিক্ষাক্রম, শিক্ষাপদ্ধতি ও শিক্ষানীতির শিকার হয়ে ভুড়ি ভুড়ি মাস্টার্স, এমবিএ, পিজিডি করা চাকুরীপ্রার্থীরা অন্তত যেনতেন করে হলেও যা কিছু একটার আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। আমি তাদের কষ্ট ও বেদনাটা নিজের হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। আমি নিজেই ওই তীব্র দুর্দিনের শিকার হয়েছি আমার ছাত্রজীবনের অবসানে।

এই বিপুল জনগোষ্ঠী যাদের মধ্যে কাজ জানা, অভিজ্ঞ সিনিয়ররাও আছেন, তারা তাদের কাঙ্খিত জবের আশায় নানাভাবে ফ্রাস্ট্রেটেড। এখানে উল্লেখ্য যে, নিজ নিজ প্রোফেশনে কেউ দক্ষ হলেও অবশ্যম্ভাবিভাবে তিনি নেটওয়ার্কিং ও কমিউনিকেশনে তুখোড় হবেনই এটা একদম গ্যারান্টেড নয়। ফলে ক্যারিয়ারের শুরুতে, মধ্যে, টপে থেকে চাকুরীপ্রার্থী মানুষ সুযোগের আশায় অত্যন্ত দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন।

এই দুরবস্থার অবসান কোনো ফেরেশতা এসে করে দিয়ে যাবেন না। যা কিছু করার, আমরা যারা কর্পোরেটে আছি, তাদেরই করতে হবে। এক্ষেত্রে জবে বা বিজনেসে কিংবা বিভিন্ন সেক্টরে সুবিধাজনক ও উঁচু পজিশনে থাকা সিনিয়রদের দায়ীত্ব অনেক বেশি। এটা তাদের নৈতিক দায়ীত্ব, জব সেক্টরের বিপদে পড়া মানুষদের জন্য কিছু করা।

সেটা যে অবশ্যই চাকুরী ম্যানেজ করে দেয়াই হবে-এমনটা নয়। প্রত্যেকে তাদের অবস্থান হতে কিছু না কিছু করতে পারেন, যেমন:-

১. সিনিয়ররা ফ্রেশার ও জুনিয়রদের সবচেয়ে বড় যে সাহায্য করতে পারেন সেটি হল, তাদের সাথে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময়। প্রফেশনাল, এডুকেশনাল, এমনকি পার্সোনাল এক্সপিরিয়েন্স বিনিময় জুনিয়রদের করবে সমৃদ্ধ। ফরমাল ক্লাসরুম, ওয়ার্কশপ, ব্লগে লেখা, ওয়েবসাইট, ফেসবুক লাইভ, ভিডিও টিউটোরিয়াল, গ্রূপ ডিসকাশন এর মাধ্যমে অভিজ্ঞ ও ফ্রেশার-সবার জন্য অবদান রাখতে পারেন তারা।

২. বুক পাবলিশিং: প্রোফেশনাল ও নন প্রোফেশনাল আইডিয়া নিয়ে কমার্শিয়ালী বই পাবলিশ করতে পারেন তারা। আমাদের দেশে এখনো প্রজন্ম হতে প্রজন্মে প্রফেশনাল আইডিয়া ট্রান্সমিট হয় সরাসরি কাজে থাকার মধ্য দিয়ে। এতে করে শুধু একজন সিনিয়র প্রফেশনালের নিজস্ব ঘরানার মানুষেরাই তার জ্ঞান ও শিক্ষাকে জানার সুযোগ পান। কিন্তু একজন অভিজ্ঞ ও মাঠপর্যায়ে কাজ করে উপরে উঠে আসার সিনিয়র কর্মীর অভিজ্ঞতাকে বইয়ের মধ্য দিয়ে ধরে রাখার গুরুত্ব অনেক।

৩. প্লাটফরম: ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টে আগ্রহী-বাঁছাই করা এমন ফ্রেশার বা প্রোফেশনালদের নিয়ে একটি ওয়ার্কিং গ্রূপ করতে পারেন তারা। যার লক্ষ্য হবে শুধুমাত্র ক্যারিয়ার স্কীল উন্নয়ন। আমাদের দেশে প্রচুর প্লাটফরম হয়ে গেছে এমন উদ্দেশ্য নিয়ে। ছড়ানো ছিটানো প্রচুর অফ ও অনলাইন প্লাটফরম হওয়ায় অনৈক্য ও বিভেদ বাড়ছে। পাশাপাশি সাহায্য প্রার্থী ও প্রোফেশনালরা বিভক্ত হয়ে যাাচ্ছেন। সবাইকে কমোন প্লাটফরমে আনাটা জরুরী।

৪. জব লিংকিং: চাকরী চান বা কর্মী চান-এমন মানুষদের মধ্যে লিংক আপ করার ভিতর দিয়েও সিনিয়র প্রফেশনালরা সমাজ ও শিল্পের জন্য অবদান রাখতে পারেন। দেশে ২৬ লক্ষ বেকার মানুষ। তার বিপরীতে কর্পোরেটগুলো উপযুক্ত লোক পাচ্ছে না। উভয় দিকেই ক্ষতি অনেক। উপযুক্ত কর্মীকে উপযুক্ত এমপ্লয়ারের সাথে লিংক করিয়ে দিতে পারলে সময়, এনার্জি, অর্থ, স্পিরিট এর অপচয় কমে যেত। অন্তত, ব্যস্ত কর্পোরেটরা তাদের নজরে পড়া যেকোনো জব সার্কুলার তাদের ফেসবুক/লিংকডইন পেজে ক্রমাগত শেয়ার দিতে থাকলেও অনেক কাজ হত। ভিতরে ভিতরে নিজের চেনা মানুষদেরই শুধু জব দিতে থাকলে, সেটা জব মার্কেটে বৈষম্য ও বঞ্চনা বাড়াবে। যোগ্যতমের অধিকার ক্ষুন্ন হবে।

৫. পরামর্শ: একজন অভিজ্ঞ ও সিনিয়র প্রফেশনাল ওপেন ফোরামে পরামর্শ/হোমওয়ার্ক/ডকুমেন্টেশন/প্ল্যানিং হেল্প দিতে পারেন, সাহায্য নিতে চান-এমন মানুষ বা প্রতিষ্ঠানকে। সেটা হতে পারে কমার্শিয়ালি বা ফ্রি।

৬. ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং: আমাদের দেশে প্রচুর মানুষ সঠিক ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এর অভাবে ভুল পথে চালিত হন, ভুল ক্যারিয়ার নিয়ে সময় নষ্ট করেন, কোন সময়ে, কবে, কখন, কীভাবে, কী করতে হবে-সেই সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে অনেকেই তাদের ক্যারিয়ারের ক্ষতি করেন। একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ ক্যারিয়ার কাউন্সেলরের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারলেও সমস্যা অনেকখানি সমাধান হত।

৭.
প্রশিক্ষণ: সিনিয়র প্রোফেশনালরা তাদের নিজের নিজের দক্ষতাকে অনলাইন স্কুল, ভিডিও টিওটোরিয়াল, ফেসবুক লাইভ, ক্লাস লেকচার, নলেজ শেয়ারিং সেশন, হ্যান্ড আউট, পাওয়ার পয়েন্ট ইত্যাদির যেকোনো একটির মাধ্যমে বিনামূল্যে কিংবা স্বল্পমূল্যে শেয়ার করে জব মার্কেটে থাকা মানুষের দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও কনফিডেন্স বাড়ানোর জন্য কার্যকর অবদান রাখতে পারেন। বিশেষত কিছু কিছু কমোন স্কিল বাড়াতে যেমন-ইংরেজি, কম্পিউটার নলেজ, ইন্টারভিউ ফেসিং, কনফিডেন্স গ্রোইং, এক্সপোজার বিল্ডিং এগুলো নিয়ে কাজ করা দরকার। আমাদের এখানে প্রচুর প্রশিক্ষণ হচ্ছে। আমার কেন যেন মনে হয়, এর মধ্যে কাজের কাজ হচ্ছে খুব কম। একই ট্রেইনিং বারবার হচ্ছে, অপেক্ষাকৃত কম জরুরী বা প্রায়োরিটি লিস্টে পেছনে থাকবে-এমন বিষয় নিয়ে সবাই কাজ করছে, এনার্জি ও অপর্চুনিরি অপচয় হচেছ। প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের সুযোগের বেস্ট ইউটিলাইজেশন করা দরকার।

৮. কালচারাল উন্নয়ন: সিনিয়র মোস্ট প্রোফেশনালরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের এইচআর সিস্টেম উন্নয়নে কাজ করা উচিৎ। তারা এইচআরের মানুষ না হলেও। আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশের একটা বড় সংখ্যক প্রতিষ্ঠান এমনকি সেমি-মাল্টিন্যাশনাল বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীরও এইচআর সিস্টেম অত্যন্ত মানহীন। তাদের রিক্রূটমেন্ট, সিলেকশন, প্লেসমেন্ট, পিএমএস, জব এলিমিনেশন-বেশিরভাগই সেঁকেলে। তার উপরে আছে তাদের এইচআরে কাজ করা মানুষদের নিচু মান। ফলাফল, এমপ্লয়ী হ্যারাসমেন্ট ও কর্পোরেট গ্রীভ্যান্স।

আমি নিজে দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের টপ ম্যানেজমেন্ট তাদের সিস্টেমের ও এইচআরের এই ল্যাকিং নিয়ে অন্ধকারে আছেন। সিনিয়র প্রোফেশনালরা আর কিছু না পারেন, নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের এইচআর সিস্টেম উন্নয়নে মালিক ও এইচআরকে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করতে পারেন। তাতেও অন্তত বাজারে পজিটিভ ইমপ্যাক্ট পড়বে। সবচেয়ে বড় প্রেক্ষিত হল, খারাপ অবস্থা যে কারো যে কোনো সময় আসতে পারে। আমি প্রচুর সিনিয়র প্রোফেশনালকে চিনি, যারা ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করার পরেও আজ চাকরী খুঁজতে নেমে পেরেশান। পরিবার, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে অমানবিক পরিস্থিতিতে আছেন। তাই এগিয়ে আসি আমার যতটুকু করার ক্ষমতা আছে-সেটা নিয়ে। আজ আমি যদি আসি, কাল আমিও কাউকে পাশে পাব।


চিলের কান নেয়ার মাহত্ম: জব মার্কেটের বড় কর্তাদের জব লিংকিংয়ে অনীহার পেটের কথা

জব মার্কেট ও কর্পোরেটের বিদ্যমান সদস্য, বিশেষত সিনিয়ররা নবাগত অথবা যেকোনো রকম চাকরীপ্রার্থীদের একদমই সাহায্য করেন না, তাদের দিকে ফিরেও তাকান না-এরকম অভিযোগ তো অসংখ্য দেখে থাকবেন।

মনে মনে নিশ্চয়ই আপনিও ক্ষুদ্ধ, কেন ভাই, একটু সাহায্য করলে কী হয়? আমি নিজেও অনেকবার আহবানমূলক কথা বার্তা লিখেছি। যদিও বিষয়টি একান্তই ব্যক্তিগত চয়েজ। কিন্তু আজকে আমার নিয়ত ভিন্ন। সামাজিক মাধ্যম ও বিভিন্ন প্রোফেশনাল নেটওয়ার্কে কেউ কাউকে বা কোনো ইস্যু বা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে একটা কিছু লিখলে, পোস্ট দিলে সেটার তলানী না দেখেই, আগপর না ভেবেই , গভীরে অনুসন্ধান না করেই হরিবোল-কাছা খোল- বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে পাঁকে নামিয়ে জুতার বাড়ি দেবার বাঙাল রীতির বিরুদ্ধে আজ বলতে চাই।

আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডিফেম করা প্রচুর পোস্ট দেখি। বড় অংশই বিক্ষুদ্ধ চাকরিপ্রার্থীদের। আজকে আমি এই গণক্ষোভের বিপরীতে কিছু তিক্ত সত্যি কথা বলব। কথাগুলো মোটেই কোনো একক ব্যক্তি বা তার কাজকে ইঙ্গিত করে নয়। কাউকে ছোট করার জন্য নয়। (ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনোই ব্যক্তির কাজ নিয়ে আবিষ্ট থাকি না।) আজ বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটা বিষয় বলব, যেটা কিছুটা ধারনা দেবে, কেন সিনিয়রর এবং প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা জব লিংকিং হতে দূরে সরে থাকেন।

কেন প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন জবের সুযোগগুলোকে আরও আরও এক্সক্লুসিভ করে ফেলছেন।

জাজমেন্টালিটি-১: 

লাঞ্চ ব্রেক চলছে। একহাতে খাচ্ছি, আর স্বভাবসুলভভাবে আরেক হাতে ইনবক্স দেখছি। একজন সিনিয়র মেসেজ দিলেন, “ভাই, দেখুন, তো, এক লোক আমাদের গ্রূপে একটা পোস্ট দিয়েছেন, আপনার প্রতিষ্ঠানের ডিফেম করে। এপ্রূভ করিনি।” স্ক্রীনশটগুলো দেখলাম। বক্তব্য হল,

“এই কোম্পানী (আমার প্রতিষ্ঠানের একটা জব সার্কুলারের স্ক্রীনশট) আমাকে ইন্টারভিউতে ডেকেছিল। আমি রংপুর হতে এসে আজ সকাল হতে বিগত ৪ ঘন্টা আদমজী বসে আছি। কেউ এটেন্ড করছে না। ফোনও ধরছে না। আমাকে সাহায্য করুন।” 

ভদ্রলোকের ইনটেনশন ডিফেম করা নয়, সাহায্য চাওয়া। কিন্তু না চাইলেও ওই পোস্ট ডিফেম করত। আগে নিজেদের সব প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হলাম, ওনাকে আমরা ডাকিনি। নানা রাস্তায় হেঁটে কনটাক্ট পেয়ে অতঃপর তাকে ফোন করলাম।

জিজ্ঞেস করলাম, আমরা তাকে ডেকেছি-সেটা তিনি নিশ্চিত কিনা। তার উত্তর হল,

“না, আপনার কোম্পানীই আমাকে ডেকেছে তা বোঝাতে চাইনি। আসলে, আমি আপনাদের ওখানে এপ্লাই করেছিলাম। কাল একজন ফোনে আমাকে আদমজী এসে তাকে কল দিতে বলল। তিনি এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। এখন তিনি ফোন ধরছেন না। আমি ভেবেছি, যেহেতু আপনাদের ওখানে সম্প্রতি আবেদন করেছি, তাহলে ওটা আপনার কোম্পানীই হবে, যে আমাকে ডেকেছে। তাই সাহায্য চাওয়ার জন্য আপনাদের নাম করেছি।”

ভাবুন সিনারিও। আমি ফোন নম্বরটা দেখলাম-আইপি নম্বর, যাতে কলব্যাক করে লাভ নেই। তবু করলাম। ফোন নম্বর ভুল। আরও জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওই কলার তাকে নিজের নাম বলেনি, কোথায় চাকরির জন্য ডেকেছে, তা বলেনি, কোম্পানীর ঠিকানা এমনকি নামটাও বলেনি। তাকে পরামর্শ দিলাম, যত দ্রূত পারেন, রংপুর ফেরত যান। আপনি ফ্রডের পাল্লায় পড়ে থাকবেন। 

এখন বলুন, ওই পোস্ট যদি সিনিয়র ভাই এপ্রূভ করতেন, তাহলে কতটা ক্ষতি হত ওনার এবং আমার প্রতিষ্ঠানের। আমার ইজ্জতের ফালুদা তো কোনোকালেই বঙ্গবাসীর কাছে ছিল না। ইনফ্যাক্ট, বাঙালী সহজ ও স্বাভাবিকতার বেইল দেয় না, ভদ্রতাকে দুর্বলতা ভাবে। বাঙালীর কাছে সেই হিরো, যার ‘এটিটিউড’ আছে (যেটা আমার নাই)। এমনকি, যেই জামাই বউকে মাঝে সাঝে পিটায় না না, বউরাও নাকি তাদের পুরুষ বলেই মানে না। এই হল বাঙালী।

জাজমেন্টালিটি-২:

আমাদের প্রতিষ্ঠানে ওপেনিং হলে আমরা প্রায় ৮/৯ টি চ্যানেলে লোক খুঁজি। তার মধ্যে অবশ্যই ওপেন মাধ্যমে সার্কুলার দিই। ফেয়ার রিক্রূটমেন্টের জন্য।

একবার একটা বিজ্ঞাপন দিলাম। এক ভদ্রলোক মন্তব্য করলেন, আমি আপনাকে এই পোস্টে এক ভাইয়ের সিভি দেবার জন্য নক করেছিলাম। রেসপন্ডই করেন না।”

আমি আমার সব ইনবক্স চেক করলাম। (উল্লেখ্য আমি নিয়মিত মেইল/ফেসবুকের জাঙ্ক বক্সও চেক করি। যেটা উত্তর দেবার মতো, সেটা দিই, যেগুলো নিতান্তই এটেন্ড করবার কথা না, সেগুলো করি না।) কোথাও তার নক নেই।

ওনার মন্তব্যে প্রতিউত্তর করলাম, কোথায় নক করেছিলেন?

“জ্বি, আমি আপনাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম।” হতাশায় নিজের চুল ছিড়ি। তিনি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে আরেকজনের জবের জন্য নক করার দায় সেরেছেন। (আমি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট সচারাচর দেখি না। ফেসবুক ফ্রেন্ড জিনিসটাতেই আমার বিশ্বাস নেই।)

আরেকবার সার্কুলার দিলাম। এক ভদ্রলোক কমপ্লেইন কমেন্ট করলেন,

“আমি আপনার ওই পজিশনে এ যাবত দেয়া সবগুলো সার্কুলারে আবেদন করেছি। একবারও ডাকেন না।” (আমাদের এখানে নানা বাস্তবতায় এখনো রিপ্লাই বা রিগ্রেট মেইল দেয়ার সামর্থ্য হয়নি। চাপ যখন কম থাকে, তখন আমরা দিই।)

তাকে বললাম, ইনবক্সে সিভি দিন। দিলেন। লোক খুঁজছি পে-রোল অফিসার। তিনি একস্থানে জুনিয়র এ্যাডমিন অফিসার। কেন তিনি ডাক পাবেন আর কেন পাবেন না-তা নিজেই জানেন না। দোষ ধরতে ষোলআনা। দুঃখে নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে। কারন, ছেড়ার মতো চুল শুধু ওখানেই অবশিষ্ট আছে।

আরেকটা সার্কুলারের কাহিনী। সার্কুলার দিলাম। এক ভদ্রলোক পার্সোনাল মেসেজ দিলেন,

“Could you plz give me a referral for this position?”

আমি দেখলাম, মেসেজটা একটা অটোমেটেড মেসেজ, যেটি লিংকডইনে কোনো এমপ্লয়ার ’জব পোস্টিং’ সেগমেন্টে পোস্ট দিলে (ওপেন পোস্ট নয়, জব পোস্ট সার্ভিসের কথা বলছি।) প্রার্থীরা নানারকম ডিফল্ট সার্ভিসের হেল্প নিতে পারেন। ওটাও তেমনি একটা-ঠিক যেমন রেকমেন্ডেশন সেবা।)

আমি দেখেই বুঝলাম, ওটা আরও অনেক আগের, একই পজিশনের জন্য আমি একবার পরীক্ষামূলক জব পোস্ট করেছিলাম, সেটা হতে উনি রেফারেল চেয়েছেন।

তবু ওনাকে বললাম, “আপনার কোনো রেফারেন্স লাগবে না। জাস্ট মেইলে সিভি দিন। আমরা ফেয়ারলী হায়ার করি।” বলার কারন হল, ওই মেইলগুলো আমি নিজে চেক করব এবং কারো ড্রপ হবার সম্ভাবনা প্রায় জিরো। তাছাড়া তার সিভি আগে হতেই আমার কাছে আছে।

ভদ্রলোক অত্যন্ত আশাহত হয়ে, রেগেমেগে এক প্রাণঘাতি পোস্ট দিয়ে বসলেন। যার মর্মার্থ হল,

“অনেকেই খুব বড় বড় লেচকার দ্যান, পীর পয়গম্বরের মতো মধুর মধুর কথা বলেন, কিন্তু সামান্য সাহায্য চাইলেই দরোজা খোলেন না।”

অর্থাৎ কিনা, ব্যাটা ভন্ড। ওয়েল, ক্ষোভ প্রকাশ ব্যক্তির স্বাধীনতা। নাম না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলে আপনাকে বলা হচ্ছে-তাও তো প্রমাণিত না। কিন্তু ওই যে, দুয়ে দুয়ে চার আছে না। আমি সবই বুঝলাম।

বেহায়া আমি ভদ্রলোককে ইনবক্স করলাম। দীর্ঘ ব্যাখ্যা দিলাম। কেন দিলাম?

আরেকবার সার্কুলার দিলাম। আমার মতো বিশাল ব্যাখ্যাসহ সার্কুলার কে কে দেন, তা জানতে খুব ইচ্ছা করে। মেইলের সাবজেক্ট কী হবে, রিজুমীর ফাইলের নাম কী হবে-তাও মাঝে মধ্যে টেমপ্লেট করে দিই।

তো, এক শ্রদ্ধেয় ভাই মন্তব্য করেছেন, আপনাকে দেখছি, এই সার্কুলারই অনেকবার পোস্ট করতে। আপনারা কি আসলেই লোক ন্যান?” এর পরে মনে মনে একটা ‘না কি……………”ও ওনার মনে থাকে। সেটা হয়তো আর উচ্চারন করেন না। মানে, আমরা কি লোক নেবার জন্য পোস্ট দিই, নাকি ধান্দা করার জন্য-ইঙ্গিত পরিষ্কার।

পড়ে আমার মনে হল, এখন হতে জব সার্কুলার দেবার আগের দিন ফেসবুক ও লিংকডইনে কয়েকবার পোস্ট দিয়ে জেনে নেব, জব সার্কুলার পোস্ট দেবার অধিকার আমার আছে কি নেই, এবং দিলে কারো আপত্তি আছে কিনা। অবশ্য তিনি নন, এই অভিযোগ আমি ৩/৪ জনের কাছে পেয়েছি। ব্যাখ্যা দিয়েছি। জব সার্কুলার দেব, সেটা এক এর জায়গায় তিন বার হলেই গেলো গেলো রব।

কেন রে, ভাই?

আমার প্রতিষ্ঠান তো মাইক্রোসফট বা গুগল না, যে, সার্কুলার শেয়ার হলেই পরের দিনই লোক পেয়ে যাব। মাত্রই একটা ব্র্যান্ডিং ড্রাইভ শুরু হয়েছে। তার ফল পেতে নিশ্চয়ই সময় লাগবে। আর এই সহজ লজিকটা কেন মানুষ ভাবে না, যে, উপযুক্ত লোক না পাওয়াতেই রিপিট হয়।

আরেকজন বললেন, আসলে লোক নেবার জন্য পোস্ট দ্যান, নাকি কোম্পানীর ব্র্যান্ডিং করেন। ভাভা গো ভাভা। আমি আমার জন্মে আজও শুনি নাই, যে, কোম্পানীর প্রচারের জন্য ৩০০ টাকার লাইট ১০০ টাকায় দেবার মতো করে মাসে দশবার একই সার্কুলার শেয়ার করা যেতে পারে। ভাভা।

রে ভাই, দুনিয়াতে সবাইকে ধান্দাবাজ ভাবতে হবে কেন? আর ভাবলে মনে মনে ভাবুন না। মানুষের মন ভেঙে দেয়া কেন? ফেয়ার রিক্রূটমেন্ট নীতিতে সবসময় একটা সামান্যতম পজিশনে লোক লাগলেও উন্মুক্ত পোস্টে লোক খুঁজি। সেটাকে এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে খোঁচাখুঁচি করলে আর কি বলে দেয়া লাগে, যে, কেন আজকাল কর্পোরেটগুলো থার্ড পার্টি বা রেফারেল হতে বেশিরভাগ লোক নিয়ে নেয়? তখন আবার এরা হৈ চৈ লাগায়, “কেন কেন কেন, কেন স্বজনপ্রীতি হচ্ছে?”

একবার এক ভদ্রলোক ইনবক্স করলেন। চাকরি চাই। পরিবার বিশাল বিপদে। সিনিয়র এক ভাইকে ফোনে অনুরোধ করে তাকে সরাসরি পাঠালাম। তিনি ইন্টারভিউ দিলেন। বেতন পছন্দ হল না। তিনি পরে জানাবেন বলে চলে যান।

তিন দিন পরে বড়ভাই জানতে চাইলেন, ওই ভদ্রলোক কেন কিছু আর জানালেন না। আমি বিব্রত। আমি ওনাকে ফোন দিলাম। ২ দিনে ৬ বার কল করার পরে ধরলেন।

“আমি আসলে একটু অসুস্থ্য ছিলাম। ……………………….ওনারা আসলে কম বেতন বলছিল। ………….আমি তো বলেই এসেছিলাম, করব না।” “আমাকে ফিডব্যাক জানাবেন না!” ”না, মানে লজ্জা করছিল…………….ভেবেছিলাম, বলব, পরে আসলে অসুস্থ………..না ভুলে গিয়েছিলাম।”

একবার এক ভদ্রলোককে ইন্টারভিউ শিডিউল দেয়া হল। তিনি এলেন না। কিছু জানালেনও না। ৩ দিন পরে রিক্যাপ করে তাকে আবার পরের সপ্তাহে শিডিউল দেয়া হল। তিনি আমাদের আদ্যোপান্তসহ কেমন কী বেতন দিতে হবে-তার ছক্কা হাঁকিয়ে শিডিউল দিলেন।

পরের সপ্তাহে যথারীতি লাপাত্তা। ফোন বন্ধ। ……………………৬ মাস পরে আমার এক সিনিয়র তার রিজুমীটা আবার দিলেন। চিনলাম। আগের ইতিহাস বললাম, তিনি কথা বলে জানালেন, সে ওই সময় পারিবারিক ঝামেলায় ছিল। তাই আসেনি। এবার কমিট করেছেন, আসবেন।

আবার শিডিউল দিলাম। ইন্টারভিউ’র আগের দিন আবার ফলোআপ কল করা হল। সব ঠিক আছে। পরের দিন তিনি হাওয়া। ফোন ধরছেন না। না, কাহিনী শেষ না। ৬ মাস পরে তিনি একদিন মেসেজ করলেন, আমাদের একটা সার্কুলার দেখেছেন, আবেদন করেছেন। একটা ইন্টারভিউ চান্স চান। …………..চান্স দিলাম। শিডিউল হল।………………তার ইন্টারভিউ আজও আমরা করতে পারিনি।

নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজটা এত সহজ না। অনেকেই জব লিংকিংকে হাউশ হিসেবে নেন, পথে নামেন, দুই চারদিন স্যান্ডেল ক্ষয় ও এমবি খরচ করে ক্ষ্যামা দেন। বিশেষত, যখন চাকরি দাতার চেয়ে গ্রহীতার গরজ কম থাকে, যখন চাকরি ম্যানেজ করার গরজ সিনিয়র বা জব লিংকারের একার হিসেবে প্রতিভাত করে দেয়া হয়, জব লিংকারদের চোখে আঙুল দিয়ে বলে দেয়া হয়,

“ব্যাটা, তুমি বড় মানুষ হইছ, অফরাদ করছ, এহন মাইনষের উপকার করতে বাধ্য, না হইলে গুনাহে কবিরাহ হবে”- তখন তো আর কথাই নেই। তারও পরে, যে সামান্য কয়জন মানুষের জন্য কিছু করতে আগ্রহী, তাদের প্রোপার সম্মান তো দূরে থাক, তাকে পদে পদে বাঁধা, অপমান কতটা আমরা করি-সেটা না হয় আর না বলি। সাধে মানুষ বৃন্দাবন যায় না।

[আবারও বলছি, এই গল্পের কুশিলবদের নিয়ে আমি মনে মনে বিন্দুমাত্র প্রিজুডিস পোষণ করি না।

একদমই ক্ষুদ্ধ নই। আর এই ঘটনাপ্রবাহের জন্য আমি আমার কাজ মোটেও বন্ধ করতে আগ্রহী নই। আবার হ্যা, এই কাজ ও কথার জন্য হাগার হাগার পেরশংসাও শুনতে আগ্রহী নই। অর্থহীন স্তুতির স্বরুপ আমার জানা। আমি স্রেফ সবার সচেতনতা ও দায়ীত্ববোধ জাগ্রত হবার আশায় অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম।

খোদা কি কসম, কাউকে ইঙ্গিত বা ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর নিয়ত ছিল না। আফটার অল-Man is mortal-মানুষ মাত্রই ভুল করে।

জব লিংকিংয়ের দায় ও আমাদের সমাজের বাস্তবতা:

প্রচুর সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের ট্যালেন্ট এ্যাকুইজিশন প্রক্রিয়া অত্যন্ত গোলমেলে আর প্রস্তুতিহীন।

এর ফাঁক গলে যারা ঢুকে পড়েন, তাদের দিয়ে প্রতিষ্ঠান কী ও কতটুকু কনট্রিবিউশন পায়-বোধগম্য সহজেই। যাহোক, নিজের লেজে কেউ যদি নিজেই আগুন দেয়-কার কী বলার আছে।

তবে, এই অপকর্মটি অন্যদেরও ক্ষতি করছে। বাজারে অসম প্রতিযোগীতা আর ব্যাড কালচারের বাইরেও আরেকটা আছে। 

মুশকীলটা হয়, এই কাজটি অন্যদের মিসগাইড করছে। মানুষ ভুল মেসেজ পাচ্ছে।

মাঝে মধ্যেই ১০০ জনকে চাকরি দিলাম, ৩০০ জন চাকরি পেয়ে গেল, অমুকের হয়ে গেল, তমুকের হয়ে যাবে-দেখে আমরা আপ্লুত হই। কিন্তু এই আবগের আড়ালে একটি সত্য চাপা পড়ে। সেটার নাম কোয়ালিটি।

যাকে নিল আর যারা নিল-উভয়ের যোগ্যতা ও সক্ষমতা কখনো কারো ভাবনায় আসে না। চাকরি পাইয়ে দেবার মহানত্বের তোড়ে ভেসে যায় সত্য।

মানুষ সাধুবাদে ভরে দেয় টাইমলাইন। লাইকের বন্যা বয়। দেবতার আসনে বসিয়ে দেয় চাকরিদাতাকে।

পেছনে পড়ে থাকে, ওই লোক এর আগে তিন যায়গা হতে অযোগ্যতা বা অসততার জন্য চাকরিচ্যুত হয়েছে।

এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’র মতো, গন্ডায় গন্ডায় জব দিয়েছি পোস্টদাতাদের কেউ প্রশ্ন করবে না, যে, ওদের মধ্য তিন গন্ডা লোকই এমন ছিল, যার ব্যাসিক যোগ্যতাটাও ছিল না।

জোয়ারে ভেসে যাওয়া  চাকরি পাবার পরে কতদিন টিকে ছিল, আর চাকরির সেই তীর্থস্থানটি কতটা কেমন ছিল-সেই খোঁজ রাখার সময় কই বাঙালীর।

মাঝখান হতে চাকরি ম্যানেজ করা দেবতার TRP তুঙ্গে।

যারা সামাজিক মাধ্যমে লিখি, বলি, আমাদের নানা ধরনের ভ্যালু এ্যাডিং কাজের পোস্ট দিই, হয়তো মনে করি, এগুলো আমাদের পোর্টফোলিওতে ভ্যালু বাড়িয়েই যাচ্ছে, বাড়িয়েই যাচ্ছে, আর চাকরির বাজারে আমাদের দর বাড়িয়েই যাচ্ছে। হ্যা, যাচ্ছে, সত্য। তবে বিপদও বাড়াচ্ছে। কীভাবে?

কয়েকদিন আগে আমার বিপদে পড়া সুহৃদকে বলছিলাম সে কথা। যিনি ইফোর্ট ও ইনিশিয়েটিভের বিচারে একজন জলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো। অন্তত আমার মূল্যায়নে। তো, এতে ভাল না হয়ে বিপদটা কোথায়?

১.চাকরি যিনি দেবেন, মানে প্রতিষ্ঠানের টপ ম্যানেজমেন্ট, তাদের আপনার, আমার এসব ফেসবুক/লিংকি কাম কাজ দেখার সময় কই? আর যদি দেখেনও, তাহলেও ভাবেন-এই ব্যাটা ম্যানেজার/জিএম তো দেখি সারাক্ষন ফেবুতে পড়ে আছে। তাকে নিলে তো কাজকাম করবে না। সারাক্ষণ ফেবুতেই থাকবে।

২.চাকরির বাজারে মালিকদের পরেই ঈশ্বর হলেন বিভিন্ন বিভাগীয় টপ বস। বিশেষত এইচআর কর্তারা। তো, তারা যখন দেখেন, আপনার জ্ঞান, ইফোর্ট, এনার্জি ও সার্বিক যোগ্যতা, যা সামাজিক মাধ্যম হতে তারা ধারনা পাচ্ছেন, তাতে আপনি তাদের একজন বিগ কমপিটিটর। আপনাকে কোম্পানীতে ঢুকতে দিলে তার চেয়ার নড়বড়ে হয়ে যাবে। সুতরাং, সে তো চাইবে, আপনি যাতে এন্ট্রি না পান। আপনার সিভি যদি তার হাতে পড়ে, তিনি নিশ্চয়ই জামাই আদর করে আপনাকে ইন্টারভিউ বোর্ডে ডাকবে না?

৩.আপনার, আমার কাজের বহর ও ধরন অনলাইনে ব্যস্ত থাকা অনেকেরই চরম ইর্ষার কারণ। এটা অনেকটা নিষ্কাম ইর্ষা আর অনেকটা নিষ্ফল ইর্ষা। কিন্তু ফলাফল একই। আপনার এই সমৃদ্ধ পোর্টফোলিও আপনার অজান্তেই বাজারে আপনার প্রচুর হেটার, কমপিটিটর ও ‘ল্যাঙ্গোট’ (ল্যাং মারতে চায় যে) জন্ম দিচ্ছে। এই ল্যাঙ্গোটরা চাকরি বা ক্যারিয়ারের বাজারে যেটুকুই হোক, যেভাবেই হোক, যেই সুরতেই হোক, আপনাকে ল্যাং মারার সুযোগ খুঁজতে থাকবেন। আর দশটা সুযোগ খুঁজলে একটা তো পাবেই।

এবার বুঝে দেখেন, আপনার সুবিশাল সামাজিক মাধ্যম ও অফলাইন কার্যক্রম কীভাবে আপনাকে আকাশে তোলার পাশাপাশি আপনার বিপদও বাড়াচ্ছে।

[এই গল্প কোনো আজগুবি গপ্প না। বাস্তব দেখে শেখা গপ্প। আর যারা আমাকে আবোলতাবোল বকিয়ে হিসেবে চেনেন, তারা বরাবরের মতোই আদ্দেক পড়ে ফোঁৎ করে শব্দ করুন আর ইনবক্সে কোনো জাস্ট ফ্রেন্ডের সাথে চ্যাটে মত্ত হোন। নো চিন্তা, ডু ফুর্তি।]

কে বা কাহারা যেন অন্তর্জালে ছড়িয়ে দিয়েছেন, আমি ’মানুষকে চাকরি দিই’। অত্যন্ত ভুল ও মিথ্যা প্রচারনা। দুকরী দত্ত হবার কোনো খাহেশ আমার নেই। আমি চাকরি দিই না। চাকরি দেয়া আমার সখ বা নেশা-কোনোটাই না। তাহলে আমি কী করি? আমি খালি ‘ইধার কা মাল উধার’ করি। যোগাযোগ ঘটাই। সেটাও শুধুমাত্র পরিচীতের ভিতরে, যোগ্যতা নিশ্চিত হলে, মাগনা আর অবসরে।

আরেকটা ক্ষীন মিথ্যা প্রচারনা আছে, সেটাও একটু বলি। কে বা কাহারা যেন অন্তর্জালে না ছড়ালেও অন্তরে অন্তরে বিশ্বাস করেন, আমি নাকি ’মানুষের চাকরি খাই’। হা হা হা, এহেম, এহম, এহেম। না ভাই, আমি খাঁটি বাঙালী। রোজ তিনবেলা ভাত খাই। চাকরির মতো কাঁটাওলা বাঁশ আমি খাই না।

যদি কেউ বিভ্রান্তিতে থাকেন, ফেসবুক, লিংকডইন পেশাগত কী কাজে আসে, তাদের জন্য একটা উদাহরন ভাগ করে নিতে পারি।

লিংকডইনে সংযুক্ত হয়ে এবং ফেসবুকে নিয়মিত যোগাযোগের প্রেক্ষাপটে একজন সিকিউরিটি সুপারভাইজারকে চাকরিতে যুক্ত করে দিই ২০১৮ সালের দিকে। তিনি এখন ওই প্রতিষ্ঠানের এ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার। তিনি ফ্রিল্যান্সিং পারেন, গ্রাফিকস পারেন। একজন সিকিউরিটি পার্সোনেল যদি লিংকডইন ব্যবহার করে ক্যারিয়ার বানাতে পারেন, আপনি কেন নন? কাল একজন ইনবক্সে একটি বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য মার্কেটিং হেড এর রেফারেল খুঁজলেন। সংগ্রহ হতে একজনকে রেফার করলাম।

কয়েকদিন আগে একজন সুহৃদের ড্রাইভার খুঁজছিলাম। একজন ড্রাইভার ইনবক্সে মেসেজ দিয়েছেন জব চেয়ে। ভাবুন একবার। জগত এগিয়ে গেছে। [না, এটা কোনো ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন নয়। আমি ভাতের বড়ি বিক্রি করি না। বিজ্ঞাপনও দিই না।]

প্রতিদিন কিছু মানুষ মেসেজ করেন, জব চেয়ে, জবের লিংক চেয়ে, রেফারেন্স চেয়ে। অতি ব্যস্ততার ভিতরেও নিজের ব্যক্তিগত সময়ে তাদের উদ্বেগের উত্তর দিই। কীভাবে আমি তাদের হেল্প করতে পারব বা আমি কীভাবে বিষয়টা নিয়ে সিস্টেম্যাটিক্যালী কাজ করি, তাদেরকে কীভাবে আমার সাথে কাজ করতে হবে-সেটা তাদের ডিটেল জানাই। তারাও জানান যে, তারা ওই পথ অনুসরন করবেন।

মুশকীল হল, প্রায় ৯০% মানুষই ওই মেসেজিং এর পরে আর ফেরত আসেন না। হারিয়ে যান। হয়তো আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কিংবা আমারই মতো আরেকজনকে এপ্রোচ করেন। তার কাছে থেকে বেরিয়ে আবার অন্য কারো কাছে। এভাবে চাকরীর চিন্তায় তাদের চাকরী হয় না। আর আমি দিনের পর দিন বিভিন্ন জবের জন্য উপযুক্ত আবেদনকারী পাইনা।

উপযুক্ত কেন বলছি, কখনো কখনো আবেদনকারীই পাই না। আরো আক্ষেপের বিষয় হল, প্রতিদিন যতজন নতুন, পুরোনো মানুষ এপ্রোচ করেন, তাদের মধ্যে মাত্র ০.৫% হয়তো এমন পাই, যারা জব নয়, ক্যারিয়ার উন্নয়নের জন্য কোনো সাজেশন চান, পন্থা জানতে চান, ট্রেইনিং বা স্কীল নিয়ে কথা বলেন কিংবা আমার লেখা কোনো ক্যারিয়ার সংক্রান্ত লেখার বিষয়ে খুঁটিনাটি দিক নিয়ে কথা বলেন।

চাকরীহীন বেকার জীবনের ভয়াবহ দুঃশ্চিন্তা, উদ্বেগ, গ্লানী-সবই আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করি ভাইয়েরা ও বোনেরা। কিন্তু বাস্তবতাও তো বুঝতে হবে। উদ্বেগে যদি পথ হারিয়ে ফেলেন, যদি সঠিক পন্থা অবলম্বন না করেন, যদি সিস্টেম্যাটিক্যালী চেষ্টা না করেন, তাতে কি সত্যিই কোনো উপকার হবে আপনার?

বিষয়টি স্বস্তিদায়ক ও স্বাভাবিক না হলেও সত্যি, চাকরির বাজার ও কর্পোরেটে কর্মরত বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের সাথে এই বাজারে আসন্ন নতুন প্রার্থীদের একটি দূরত্ব রয়েছে। এই দূরত্বের কারণ, পশ্চাতপট এবং স্বরূপ যাই হোক, তার ফলাফল একই। বাংলাদেশে বেকারত্ব নিয়ে যত যত তথ্য জানা যায়, তাতে দেখা যায়, বেকার মানুষদের সংখ্যা কোথাও ২৬ লক্ষ, কোথাও ৪ কোটি ৮০ লক্ষ।

এর ভিতরেই প্রতিবছর বাজারে যোগ হচ্ছেন আরো ৭ লক্ষ স্নাতক। বাড়ছে প্রতিটি পরিবারে আয় করার চাপ। তার সাথে পাল্লা দিয়ে কর্মরতদের আয় বৃদ্ধির চাপ। কসমেটিক উন্নয়নের ধাক্কায় টিকে থাকতে হলে, আপনি না চাইলেও আপনাকে আয় বাড়িয়ে যেতে হবে। যে যেমনটাই ভেবে থাকুন, চাকরির বাজারের এপাড়ে, অর্থাৎ যারা কর্মরত আছি, আয় করি, যাদের একজন আমিও, তাদেরকে ওপাড়ের, অর্থাৎ কর্মহীন কিংবা সদ্য স্নাতক বাজারিরা হয়তো ভেবে থাকেন, উদাসীন, বেখেয়াল, সহমর্মীতাহীন ও পাষাণ। কিন্তু সত্যিটি হল, আমরা প্রতিনিয়তই বাজারের খোঁজ রাখি। অবস্থা বোঝার চেষ্টা করি। বেকারদের ভয়াবহ দুঃস্বপ্নকে অনুভব করার চেষ্টা করি।

গতকালও এক ভদ্রলোকের চাকরির ইন্টারভিউয়ের অভিজ্ঞতা পড়ছিলাম। নিজের বেকার দিনের সাথে মিলিয়ে দেখি। এ এক ভয়ানক অব্যক্ত যন্ত্রনা। বেকারত্ব একজন মানুষকে সালফিউরিক এসিডের চেয়েও তীব্র দহনে পোড়ায় রোজ। প্রতিদিন বাবা-মায়ের অসহায় মুখ, বোনের করুন চাহনী, স্ত্রীর মলিন দৃষ্টি, সমাজের বক্রকটাক্ষ, অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যত-এ এক দুঃসহ বেদনা। আমি চোখ বুঁজে আমার বেকার দিনগুলোর জঘন্য স্মৃতি ভোলার চেষ্টা করি। আল হামদু লিল্লাহ! সর্বময় প্রভূ কিছু একটা উপায় করে দিয়েছেন।

আমি যদিও জানি, আপনারা সবাইই বিষয়টি নিয়ে ভাবিত। নিজের নিজের মতো করে সবাইই এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন। গোপনে, প্রকাশ্যে। আমি শুধু গতকালকের লেখাটি পড়ে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে কথাগুলো তবু লিখতে বসলাম। দেশের চাকরির বাজারের অবস্থা সত্যিই অত্যন্ত ভয়াবহ। চাকরি অতীতেও অধরা ছিল। এখনও। কিন্তু অতীতে তাও একরকম সামাজিক নিরাপত্তা ছিল। চাকরি না হলে গ্রামে বাবার জমিতে চাষবাস করেও চলে যেত। কসমেটিক উন্নয়নের পৃথিবীতে সেটাও সম্ভব না।

কারন, এই কসমেটিক উন্নয়নে সবার আগে শেষ হবে কৃষকগোষ্ঠী চাষারা। চাকরির একটি পদের বিপরীতে কয়েক হাজার করে দরখাস্ত। চাকরিপ্রার্থীরা উদভ্রান্তের মতো দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। যে যা করতে বলছেন, করছেন। যে যেমন উপদেশ দিচ্ছেন, তাই অবলম্বন করছেন। মেসের ভাড়া বাকি পড়ছে, খাবারের টাকা বাকি পড়ায় উপোষ দিচ্ছেন, প্রেমিকার বিয়ে আটকাতে না পাড়ায় মাদকাসক্ত হচ্ছেন, বাবা-মা’র মুখের দিকে তাকাতে না পেড়ে ঘরে ফেরা অনিশ্চিত করে দিচ্ছেন, চাকরিস্থলে প্রতারনার/অন্যায়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। হাজার হাজার প্রার্থীর ভিতরে একজন চাকরিটি পেলে স্বাভাবিকভাবে সবাই তাকে “মামুর জোরে” পেয়েছেন বলে অভিশাপ দিচ্ছেন।

হয়তো তাই। সে বেচারাও হয়তো এমনি ঠেকে ঠেকে ঠকে ঠকে তারপর একজন মামুকে ধরেছেন। কথা বাড়াব না। আপনাদের সময় কম। জানি, প্রার্থীদের অনেক দোষ। অনেক অসঙ্গতি আছে। কিন্তু, তাতে মূল ফলাফলতো একই থাকছে-৪.৮ কোটি বেকার আর অসহায় বাবা-মা’র শূন্যদৃষ্টি। বাজারে যাদের (সত্যিই) অযোগ্য ও অনুপযোগী বলে আমরা নিতে পারছি না, তাদের ক্ষেত্রেও, দোষটি একার নয়। দোষ গোটা ব্যবস্থার।আমি জানি, প্রত্যেকে এটা নিয়ে চিন্তিত। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করছেন।

তবুও বিষয়টি মনে করাই। হয়তো আপনি যতটা ভাবছেন, বিষয়টা তার চেয়েও অনেক অনেক গুরুতর। ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয়ের সামনে আমরা। যতটা পারুন, করুন। যতটা। সামান্য উপদেশ হতে শুরু করে একটি ফোন কল। যেটাই হোক। একজন বেকারকেও যদি জীবনে চাকরি দিয়ে দেয়া সম্ভব হয়, তাহলেও সংখ্যাটি ৪ কোটি ৮০ লক্ষ হতে ৪ কোটি ৭৯ লক্ষ ৯৯ হাজার ৯৯৯ হবে।

প্রতিদিন অন্তত ২৫ টা মেসেজ আসে বিভিন্ন মাধ্যমে চাকরীর ব্যাপারে সহায়তা চেয়ে। একেকটির ধরন একেক রকম। বেশিরভাগই ভুল এপ্রোচে বা ভুল পদ্ধতিতে। তবুও তাদের জন্য নিয়মতান্ত্রিক পথে চেষ্টা করি। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দিয়ে যেটা করতে পারব সেটা তাদের বলি আর তাদের কী করতে হবে সেটা বলে দিই। আমার নিয়মতান্ত্রীক ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শুনে বেশিরভাগই চুপ হয়ে যান। কেউ কেউ আগ্রহ দেখান কিন্তু পরে আর ফেরত আসেন না।

যারা ওই প্রক্রিয়াতে জড়িত হন, তাদেরও একটা বড় অংশ পড়ে নিরব/ইনএ্যাকটিভ হয়ে যান। আমার হাতে যখনি কোথাও হতে কোনো জবের সার্কুলার আসে, [ইদানিং প্রায়ই বিভিন্ন জন ফোন করে মানুষ চান], ওপেন ফোরামে আমার ওয়ালে, আমার ফেসবুক পেজে, লিংকডইন পেজে শেয়ার করি। এমনকি আমার একটি এক্সক্লুসিভ মেসেঞ্জার গ্রূপ আছে। সেখানেও দিই।

কিন্তু মুশকীল হল, সারাবছর যারা জব চান, যাদের ভাল সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে বলি, যখন মানুষ খুঁজি, তখন আর তাদের পাই না। সবচেয়ে বেশি অনুরোধ আসে ফ্রেশারদের। এমনকি আমি চাকরী নিয়ে কোনো সার্কুলার বা পোস্ট দিলেই অন্তত একটা হলেও অনুযোগ আসে, কেন ফ্রেশারদের জব দিই না। সেই আমি গত ১ মাসে অন্তত ৫টা সার্কুলার দিয়েছি বিশেষভাবে ফ্রেশারদের জন্য। রেসপন্স রেট ৫%।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, তিনবার মার্চেন্ডাইজার চেয়ে বিজ্ঞাপন দিলাম। সিভি এসেছে মাত্র ৫টা। আজব দুনিয়া। আমার কাছে মনে হয় কি [আমার ভুলও হতে পারে], চাকরী পাবার ব্যাপারে আমরা যতটা উৎকন্ঠিত ও উদগ্রীব, চাকরী পাবার নিয়মতান্ত্রীক পথে হাটতে আমরা ততটা উৎসাহী না। আমি গত ১ বছরে অন্তত ২০ টা সংগঠিত লেখা দিয়েছি কীভাবে জবের জন্য প্রস্তুত হতে হয়, খুঁজতে হয়, কীভাবে লিংকড হতে হয়, কীভাবে ইন্টারভিউ দিতে হয়, কেন জব হচ্ছে না, কীভাবে মামা-খালু যোগাড় করতে হয় ইত্যাদি নিয়ে। এগুলো হতে কেউ শিক্ষা নিয়েছেন কিনা জানি না।

প্রায়ই বিভিন্ন জনের জব চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিই। হতে পারে, সবার হাতে সুযোগ নেই। কিন্তু এই সামান্য মেসেজটি শেয়ার দিতেও আমরা কার্পন্য করি। ভীষন হাই প্রোফাইল কয়েকজন প্রোফেশনালকে কয়েকজন মানুষের জবের বিষয়ে এপ্রোচ করেছিলাম। তাদের গলার স্বরে মনে হয়, ভিক্ষা টিক্ষা চাইবার জন্য ফোন করেছি। প্রচুর জ্ঞানী গুনী সিনিয়র প্রোফেশনাল আমাদের চারপাশে।

আপনারা দয়া করে যদি একটু নিজের নিজের প্রতিষ্ঠানের কাজের পাশাপাশি অবসর হতে কিছুটা সময় বাইরে দিতেন-স্কীল উন্নয়ন ও জব প্রোভাইডিং এর বিষয়ে, তাহলেও দিশাহারা মানুষগুলো কিছুটা উপকার পেত। শুধু একটা কথা বলি। বাংলাদেশের চাকরীর বাজার অত্যন্ত ভয়াবহ একটা সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। তাই জব সিকাররা, সিরিয়াস হয়ে যান। নিয়মতান্ত্রীক পথে এগোন। রুজির মালিক সৃষ্টিকর্তা।


সিনিয়রদের জব সিকিউরিটি:
(ক তে ক্যারিয়ার- কেন্দ্রবিন্দু-বইমেলা ২০২৪ এ প্রকাশিত।)

আমার ৬১ বছর বয়সী একজন সাবেক সহকর্মী তার ৫৬ বছর বয়সে হঠাৎ চাকরিচ্যুত হন গত ৫ বছর আগে।
সেই হতে এই ৫ বছর তিনি ঠিক কীভাবে যে সারভাইভ করেছেন, কী কী না করেছেন, কোন কোন পথে গেছেন, কাকে কাকে কীভাবে আমড়াগাছি করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
সামহাউ, হি সারভাইভড।
আজকে কথাচ্ছলে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কেমন আছেন?”
আমি বললাম, “আমি আরামের নিশ্চিত জীবনের প্রান্তে পৌছে অনিশ্চিত ও ঝঞ্ঝা বিক্ষুদ্ধ জীবন সংগ্রামে নামব নামব অবস্থায় আছি।”
৫৫-৬০ বছর বয়সে পৌছে যাবার পরেও অবসর নেবার সাহস করার সুযোগ নেই। এবং জীবন তখনো রোজ ঠিকা আয়ের ওপর ব্লাইন্ডলি ডিপেনডেন্ট।
চাকরি হারানোর শঙ্কা, আজ বেকার হলে কালই হুকো-নাপিত বন্ধের আতঙ্ক। ছেলেমেয়ে, মায় বউ/স্বামী বিট্রে করার শঙ্কা।
বেশ আছি কর্পোরেটে।
অল্প বিস্তর পরিচীত একজন প্রফেশনাল (নামটি বলছি না।)। জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানে অতি উচ্চ পদে চাকরি করতেন। সার্বিকভাবে বেশ হায়ার স্ট্যান্ডার্ড লাইফ লিড করতেন।
ভদ্রলোক গত আগস্ট মাসে একদিন সকালে ১০ মিনিটের নোটিসে পরলোক গমন করেন। মৃত মানুষের যেহেতু নিজের মৃত্যুর আপডেট ফেসবুকে দেয়া সম্ভব না, আর পরিবার শোক সামলে ফেসবুককে তার চলে যাবার খবর জানাবার মতো আধুনিক হয়নি, বিধায় তার খবর জানতাম না।
ডিসেম্বরের এক দুর্দিনে অসংখ্যবার নানা মাধ্যমে তাকে ফোন, মেসেজ দেবার এক পর্যায়ে ভাবী ফোন ধরেন আর তখনই দুঃসংবাদটি জানতে পাই। চোখের দেখাও যার সাথে কখনো হয়নি, তার মৃত্যুর খবরে তবুও ধাক্কা খাই।
ভদ্রমহিলাকে কী বলব-তা বুঝতে পারি না। তিনি যখন বললেন, “আপনার সাথে ওঁ’র কেমন পরিচয়? জানলেন না।”-
আমি লজ্জায়, শরমে, সংকোচে মরে গেলাম।

সমাজের বেশ ওপরের স্তরে বসবাসরত সুখী ও সমৃদ্ধ পরিবারটি এই একটি মিসহ্যাপ এর মধ্য দিয়ে ভয়ঙ্কর এক দুঃসময়ে পতিত হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে। একদম আকাশ হতে মাটিতে।

ভদ্রমহিলা ১৫ বছর আগে পড়াশোনা শেষ করবার পরে, স্বামীর ভাল চাকরির কারণে, বাচ্চাদের ‘মানুষ’ করবার তাগিদে কখনো পেশায় যোগ দেননি। ১৫ বছরে এমপ্লয়্যাবিলিটি জিরোতে ঠেকেছে। অভ্যাস নষ্ট হয়েছে, নেটওয়ার্ক জিরো হয়েছে।
ভাইয়ের অফিস আশ্বাস দিয়ে দায় সেরেছে। কলিগরা ব্যস্ত হয়ে গেছে। বন্ধুরা কী হতে পারে-সেটা বলতে হলে মুখে ফেনা উঠবে। দুই দিকের পরিবারে বাবা-মা, ভাই-বোন বলতে তেমন কেউ নেই। উচ্চ আয় হলেও সেটা একজন চাকরিজীবির এই বাজারে এতটাও সুউচ্চ কখনো হওয়া সম্ভব না, এত সঞ্চয়যোগ্যও না, এত সঞ্চয় হয়ও না, এত বেশি এসেটও চাকরি করে কখনো বানানো হয় না, যেটা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চলে গেলে সহায় হতে পারে। বিশেষত এই জোর করে বানানো উন্নত দেশে।

সব মিলিয়ে ভীষন দুর্বিসহ দুর্দিন নেমেছে মাত্রই সেদিনও ইর্ষণীয় জীবনযাপন করা একটি পরিবারের।
যারা স্বামীর উচ্চ আয় ও সক্ষমতাকে ভর করে, বাচ্চাদের ‘মানুষের মতো মানুষ’ করবার অভিপ্রায়ে যোগ্যতা সম্পন্ন স্ত্রীদের দিন দিন অকর্মণ্য করে তুলি, তারা আরেকবার ভাবতে পারি। পরিকল্পিত সুখী পরিবারের জন্য, বাচ্চাদের জন্য, সমাজের ট্যাবুর ভয়ে, মুখরোচক রাতের খাবারের লোভে, সেবা পাবার টানে, অবহেলায় যে ঘরণীকে, যে অর্ধাঙ্গিনীকে, যে লাইফ পার্টনারকে আমরা কার্যত বেকার ও অকেজো মালে পরিণত করি বা হতে দিই বছরের পর বছর ধরে,
দুর্দিনে তার ঘুরে দাড়ানোর উপায় কী হবে-কখনো ভেবেছি কি? (আমি নিজেও এই ভাবনায় বুঁদ আছি সেদিন হতে।)
বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন, নারী ক্ষমতায়ন ও নারী মুক্তির চরম সাফল্য অর্জিত হয়ে গেছে এবং তার চরমতম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শিত হয়ে গেছে-এমনটা যদি কেউ ভেবে থাকেন, তাকে একটা পেন্নাম।

পেন্নাম, কারন, তিনি বিশ্বের চরমতম পজিটিভ মানুষ।

এবার চরমতম নেগেটিভ মানুষটার ভাবনাটা বলি।

Women at work কিংবা Working woman কেই যদি উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন বা মুক্তির পারদ হিসেবে দেখা হয়, তাহলে মজার বিষয় হল,
আমাদের গোটা কর্পোরেট সমাজ, জামজনতার সমাজ, বঙ্গীয় আধ্যাত্মিক কনট্রাকটর সমাজ-সব সমাজের কাছেই, এখনো ‘পুরুষ’ ডিফল্ট চয়েজ হিসেবে প্রবল প্রতাপে বিরাজমান। কর্পোরেট নারী এখনো ‘পুরুষের সাবসটিটিউট’, ‘ফাইন্যান্সিয়াল সাপোর্টার’, ‘বিকল্প ইনকাম’, ‘মন্দার চাপ সামাল’-এসবেরই প্রতিভূ। নারীর আয় করাটা এখনো সখ, ডিগনিটি, দুঃসাহস, ঠেকা-এসবেই ঘুরপাক খায়।

নারীর চাকরি বা ইনকাম-এখনো তার তথাকথিত সহযাত্রী ‘পুরুষ’দের কাছে পরম প্রিয় একটি কাজে রুপান্তরিত হতে পেরেছে বলে মনে হয় না। আপনার বিশ্বাস হোক, বা না হোক, ’পুরুষ’ সহকর্মীরা ইন জেনারেল একজন ‘নারী’কে তার সহকর্মী হিসেবে দেখাটাকে এখনো রিলিজিয়াসলি ও লিটারালি নিতে পেরেছেন-এটা বুক ফুলিয়ে বলা যাবে কিনা-ভাবতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা অনুনয় সূচক পোস্ট প্রায়ই চোখে পড়ে, যেখানে আহবান করা হয়েছে, একটি চাকরি খালি হলে সেটা একজন মহিলাকে না দিয়ে একজন ‘পুরুষ’কে দেয়া হোক, কারন, ”একজন নারী চাকরি পেলে মাত্র সেই বেঁচে যাবে, অথচ, একজন পুরুষকে দিলে নাকি দুটো আস্ত পরিবার বেঁচে যাবে।” কী ভয়ানক কথা! পরিবারের নারী ও পুরুষটি একই সমান ক্যারিয়ার হবার পরেও, চাকরি ছেড়ে পরিবার সামলাতে হলে, কে তবে ক্যারিয়ার কুইট করবে-এই বিকল্পের এখন তক এ্যাবসলুট কম্প্রোমাইজার নারী সদস্যটিই।

যত নারী ও পুরুষকে ইন্টারভিউ করি, সবার একই উত্তর-’বউ ঘরে ফিরে যাবে, বাচ্চা সামলাবে।” [অবশ্য ২ জনকে পেয়েছি, ১ জন পুরুষ, ১ জন নারী, তারা বলেছেন, পুরুষটিও ফিরে যেতে পারেন, যদি সেটা সার্বিকভাবে ভায়াবল হয়।] যত নারীর ইন্টারভিউ করেছি, সামান্য ব্যতিক্রম বাদে, তাদেরও মানসিকতা হল, পরিবার, নাকি ক্যারিয়ার-এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাড়ালে তারা পরিবারকেই বেছে নেবেন।

সব মিলিয়ে (আপনার দ্বিমত পোষণের সব অধিকারকে সম্মান করেই বলছি, এবং, এসব কথার কোনো গবেষণা বা জরিপমূলক সত্যতা নেই জানিয়েই বলছি), নারীবাদ ও নারীসাথ-এসব বিতর্কে আমাকে জড়ানোর ঝুঁকি নিয়েই বলছি,
Women at work এখনো “টিমে একটা মেয়ে থাকলে ভালই লাগে’তে আটকে আছে কিনা, একবার ভাবাই যায়।
প্রাইভেট সেক্টরে, বিশেষত RMG সেক্টরে, ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌছানো প্রোফেশনালরা সম্ভবত জব সিকিউরিটির আসপেক্টে মোস্ট ভালনারেবল গ্রূপ, অথচ তাদের হবার কথা ছিল সবথেকে ডিমান্ডেড পারসন।

বাংলাদেশের ট্যালেন্ট, জব মার্কেট ও কর্পোরেটে একজন চাকরিজীবি প্রফেশনালের Life Cycle কতদিন?

১০ বছর?   ১৫ বছর?   ২০ বছর?   ২৫ বছর?

গড়পড়তা ২৪ – ২৫ বছর বয়সে আমাদের চাকরিজীবন শুরু হয়। ২০ বছর জব হওয়া মানে ৪৫ বছর বয়স। এখন তক আমাদের প্রাইভেট কর্পোরেট কমিউনিটি তার খুব বেশি জেনারেশন রোল আউট করেনি। তাই বিষয়টা খুবই ঘোলাটে, কারন, আমাদের সামনে, আগে, পিছে খুব বেশি উদাহরণ তৈরী হবার সময় হয়নি। তাই, আমরাও খুব পরিষ্কার না, যে, বটলনেকটা কতটা হবে, সেটা কীভাবে মোকাবেলা করে সফল হওয়া যাবে, বা হয়েছেন আমাদের আগের ব্যাচগুলো।

ফলে, বয়স ৪৫, কিংবা ক্যারিয়ার ২০ বছর পৌছালে, আমাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ২০ বছরের পরে ক্যারিয়ার ধুঁকে ধুঁকে, ধাক্কা, উষ্টা খেয়ে চলবে, নাকি থেমে যাবে-এই ভ্যালিড প্রশ্নটা অনেকের মনেই হয়তো উঁকি দেয়। যেখানে ২০ বছরের ক্যারিয়ারের পরে তার হিরার মতো দামী ও কাঙ্খিত হয়ে ওঠার কথা, বাংলাদেশে সেই সময়টাতে পৌছালে ইয়া নফসি ইয়া নফসি শুরু হয়-মনে হয় এই বিষয়ে অনেকেই একমত হবেন। প্রিয় কর্পোরেট কমিউনিটি, ২০ বছর ক্যারিয়ার বা বয়স ৪৫ হবার পরের ক্যারিয়ার কতটা স্মুদ, স্পনটিনিয়াস, কনজেকিউটিভ-কী মনে হচ্ছে?

আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব ভাবিত, যে, সিনিয়র মোস্ট প্রোফেশনাল যারা, তাদের ভবিষ্যত কী? বা যারা ধীরে ধীরে নিজেকে সিনিয়র লেভেলে নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখেন, তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে?
জগতের সব দেশে, প্রোফেশনালরা যত সিনিয়র হন, তাদের মার্কেট প্রাইস, ভ্যালু প্রোপোজিশন, ডিমান্ড, রিকগনিশন, ইউটিলাইজিশন ততটাই বাড়ে। তাদের আরও ভ্যালু এ্যাডেড কাজে ইউটিলাইজ করা হয়;

আরও অর্থবহ কাজে তাদের সংযুক্ত করার উদ্যোগ রাষ্ট্র ও ইন্ডাস্ট্রি নিজের গরজেই তৈরী করে। তারাও কনট্রিবিউট করেন।
এই দেশে মোটামুটি জিএম লেভেলে পৌছানো গেলেই শুরু করতে হচ্ছে ইয়া নফসি ইয়া নফসি।
তার পরে কী-কেউ জানে না। ক্যারিয়ার হয়ে যায় আরও বিপদসঙ্কূল, আরও ত্রিশঙ্কূ। সিনিয়র প্রোফেশনালদের ইউটিলাইজ করা তো দূরে, তারা তখন থাকেন দৌড়ে।

প্রোফেশনের সবথেকে রিচ অবস্থায় পৌছানোর পরে তাদের আরও কাজে লাগানো তো দূরে, দুটি ডালভাতের ব্যবস্থা কী করে হবে-সেই চিন্তাই তখন তাদের জন্য মুখ্য হয়ে দাড়ায়।

এমনিতে বিগত ২৫ বছরের ক্যারিয়ার হতে তো নিশ্চয়ই কোটি কোটি টাকা সেভিংসও বানানোর মতো বেতন বা আয় সবার হওয়া সম্ভব না।
শেষ বয়সে তাই অত্যন্ত একপিরিয়েন্সড, রিচ প্রোফেশনালকে নতুন করে সেই ফ্রেশার বয়সের মতো খুঁজতে হয় জীবিকার নতুন পথ।
আগুন বোতল (এক্সটিংগুইসার) বিক্রীর মুদী ব্যবসা, নয় তো আলু পটলের আড়তদার, বাসা ভাড়া দিয়ে বাড়িওলা বনে যাওয়া, কখনও বা স্কুল মাস্টার।
আপনারা কি কেউ একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, যে, এই খাতের প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের সিনিয়র মোস্ট প্রোফেশনালরা ঠিক কীভাবে ইন্ডাস্ট্রিতে কনট্রিবিউট করার বদলে উল্টো ঝরে গেছেন বা যাচ্ছেন?
তারা যে হারিয়ে যাচ্ছেন?

কতজন সিনিয়রকে আমরা দেখেছি, ৫০+ বয়সের পরে একই সেকটরে আরো ভ্যালু এ্যাডেড কাজে কনট্রিবিউট করার সুযোগ পেতে?
আমি তো দেখতে পাচ্ছি, সিনিয়র মোস্ট পারসনরা তাদের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের যাবতীয় মূল্যবান অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, রিচ নলেজ নিয়ে অবহেলিত, অনাদৃত অবস্থায় নিজেকে প্রতিনিয়ত বিক্রী করে নিজেকে ও পরিবারকে প্রোভাইড করার দূরহ যাত্রায় নামছেন।
সেই ফ্রেশার বয়সের মতোই। বাধ্য হচ্ছেন সেটা করতে।
কনসালট্যান্সী বা এ্যাডভাইজরী সার্ভিস বিক্রীর কথা অনেকে বলবেন। ভাই রে, দক্ষ প্রোফেশনাল হলেও দক্ষ ব্যবসায়ী তো সবাই হবেন না। একের ভেতর পাঁচ তো সবাই হবে না। ডাইভারসিফাইড হতে বলবেন?

আমি সেটাকে ব্যক্তির দায়ের সাথে নিশ্চয়ই কবুল করব। কিন্তু, একটি সেক্টর কেন তার সবথেকে রিচ রিসোর্স হতে তার বেস্ট ভ্যালুটাকে কাজে লাগানোর স্কোপ তৈরীর দায় ও গরজ অনুভব করবে না?
কেন সে ২৫ বছর ধরে সমৃদ্ধ হওয়া একজন রিসোর্সকে স্রেফ রাস্তায় ঘুরে ঘুরে নিজেকে ফেরী করার ক্ষমতার ওপর ছেড়ে দেবে?
তার থেকে কিছুই কি নেবার নেই? তার ভান্ডারে থাকা রিসোর্স কাজে লাগানোর কি কোনোই দরকার নেই?
তাহলে একটি সেক্টর কীভাবে সারভাইভ ও সাসটেইন করে?
আমার জিজ্ঞাসা। আমি চিন্তিত।

আমি বেশ ক’জন সাবেক উচ্চপদস্থ পেশাজীবির কথা জানি। একেক জন ৬ মাস হতে ৩ বছর ধরে জবলেস। (বেকার বলিনি, জব নেই বলেছি।) সবভাবেই তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার যে কোনো যোগ্যতা নেই-তা ও নয়। কিন্তু হয়নি। মনে রাখতে হবে, প্রাইভেট বা পারসোনাল লিমিটেড কোম্পানীতে জব হওয়া আজকাল আর কেবলমাত্র মৌলিক যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে না। সহযোগী যোগ্যতারও দরকার হয়।

আমি অনেক মানুষকেই দেখি, নিজ যোগ্যতা ও অবস্থান নিয়ে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষক এবং গর্বিত। তাদের সার্বিক জেসচার, পশচারে একটি মেসেজ খুব খোলাখুলি তারা ছড়িয়ে দিতে চান, যে, তার যে মহাদেবতুল্য যোগ্যতা, সক্ষমতা ও মার্কেট ভ্যালু, সেটি নিয়ে তিনি যে তার বর্তমান প্রতিষ্ঠানে জব করে যাচ্ছেন, সে ই ঢেঁড়। মানে, তার মতো মানুষ যে এই প্রতিষ্ঠানে জব করছেন, সেটাই বিশাল করুণা করা। তা না হলে তাকে পালকী দিয়ে তুলে নিয়ে যাবার জন্য হাজারটা কোম্পানী হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। অনেকটা “আমি বলে তোমার সংসার করে গেলাম” টাইপ।

গোল বাঁধে চাকরিটা ছাড়লে বা গেলে। কোনো কারণে সেটি অবসান হলে, একবার বেকার হয়ে পড়লে, তিনি দেখেন, যে, অবস্থা অন্যরকম, যেখানে উল্টো ঘরে আরেকটা বউ নিয়ে এসে জামাই বলছে, “এই যে, দেখো, খালি তুমি একা না, আমার ঘর করবার জন্য আরো একজন আছে।”
উনি ভাবতেন, তিনি চলে যাবেন-এমনটা ঘুনাক্ষরেও যদি প্রকাশ পায়, কোম্পানী সমস্ত মাজারে শিন্নি দেবে, মন্দীরে লাল সুতা বাঁধবে, তার বাড়ির সামনে অনশন ধর্মঘট করবে-যাতে তিনি না চলে যান। হুলস্থুল TRP ।

বাস্তবে হয় ভিন্ন। কোম্পানী শিন্নি দেয় ঠিকই। মন্দীরের বটবৃক্ষে লাল-হলুদ গেড়ুয়া সুতাও বাঁধে। তবে সেটা তাকে ফিরে পেতে না, বশিভূত করতে না। বরং, তার হাত হতে মুক্তি পেয়েছে-সেই সুখে। তখন……………..

পালকি তো দূর কি বাত, দরোজা খুলে রেখেছে-এমনই কাউকে সহসা চোখে পড়ে না।

গাটস থাকা ভাল। সাহস ও আত্মসম্মান থাকা জরুরী। তবে দুঃসাহস, অহংকার ও ভুল আত্মবিশ্বাস ভাল নয়। আত্মবিশ্বাস বিহীন মানুষ মৃত। তা সত্যি। তবে তা সত্তেও একটা সত্য হল, আত্মবিশ্বাসকে বারবার প্রশ্ন করতে থাকতে হয়। কারন, আপনার আত্মবিশ্বাস আর সত্য এক নয়। যেমন ধরুন, আপনার জ্বর হল। আপনার ঠান্ডা লাগবে। ঘোর গ্রীষ্মকালেও। মনে হবে চারপাশে ৪ ডিগ্রী তাপমাত্রা। তখন আপনার পাশে বসা কেউ আপনাকে বলবে, কই ঠান্ডা, প্রচন্ড গরম, এবং, দেখবেনও তিনি ঘামছেন। এখন, আপনাকে কি বিশ্বাস করানো যাবে যে, সত্যিই পরিবেশ গরম? যাবে না। আপনার আত্মবিশ্বাস বলবে, এখন শীতকাল। আপনার পাশে বসা মানুষটির আত্মবিশ্বাস হল, এখন গরমকাল। এবং যে যেখানে আছেন, সেখানে থাকা তক আপনার বেস্টটা দিন, এই যে আপনি কোথাও আছেন, সেটির শুকরিয়া করুন। হয়কো আপনি সেখানে নিজেকে ওভারফিট ভাবেন, কিন্তু ছেড়ে দিয়ে আরেকটি বেস্টফিটে যাবার সব স্কোপ আপনার সপক্ষে নাও থাকতে পারে। এক থাকতে এক দাও-মার্বেল খেলার এই নীতি মনে পড়ে?


ভেটেরানদের নয়া আপদ: ঘাটের মরার জীবন

একটি নতুন trend আঁচ করছি। দু-চারজনের কাছেও শুনছি।

সেটি হল, ইদানিং সিনিয়র লেয়ারের কর্মী চলে গেলে, কিংবা তাড়িয়ে দিয়ে জুনিয়ের লেয়ার দিয়ে সেই ডেস্ক পরিচালনা করবার একটি নিরব প্রবণতা নাকি খুব বাড়ছে। বিধায় সিনিয়র পজিশনে, বিশেষত GM, VP, Director লেভেলের হায়ারিং অপরচুনিটি খুব কম চোখে পড়ছে। যেমন, কারো CHRO চলে গেলে ম্যানেজারকে দিয়ে বিভাগ চালাচ্ছে।

প্রথম শোনায় মনে হতে পারে, যে, এটা Succession planning & internal resource planning এর দারুন প্রয়োগ।

সেটি হলে দারুন হত।

কিন্তু যেটা করার চেষ্টা হচ্ছে, সেটাকে বলা যায় বুলডোজারের কাজ হাতুড়ি দিয়ে সারার চেষ্টা।

যোগ্য অভ্যন্তরীন জুনিয়রকে প্রমোট করে সিনিয়রের দায়ীত্ব দেয়া তো বিশ্বজুড়ে নন্দীত।

কিন্তু জিএম চলে গেলে বা সরিয়ে দিয়ে ম্যানেজারকে সেখানে ম্যানেজার রেখেই স্থায়ীভাবে টিম পরিচালনার চর্চাকে সাধুবাদ জানানো অসম্ভব।

ম্যানেজার কখনোই জিএম এর ভূমিকা নিতে পারে না। অফিসার ম্যানেজারের বিকল্প হতে পারেন না। ম্যানেজার সাময়িক ব্যাকআপ হতে পারেন। যোগ্য হলে ট্রায়াল শেষে তাকে জিএম এর চেয়ার দিতে হবে। নিচ হতে বা বাইরে হতে ম্যানেজার আনতে হবে। কিন্তু একদম জিএম এর চেয়ার অ্যাবোলিশ করলে লাভ নেই।

ম্যানেজার যদি জিএম এর, কিংবা অফিসার যদি ম্যানেজারের দায়ীত্ব ও ভূমিকা পূরণ করতেই পারে, তাহলে এতদিন আপনি জিএম বা ম্যানেজারকে যে প্রোভাইড করেছেন, সেটাই ছিল বড় গলদ।

”রাজার কাজ কি প্রজা দিয়ে হয়?” আলো, আলো, বেশি আলো,……………..প্রয়াত মিজ মিতা নূরের মডেলিংয়ে করা এই বিজ্ঞাপনটার মূল মেসেজটার কথা কি মনে পড়ে?

রাজার কাজ প্রজা দিয়ে করানো যায় কিনা? ষাড়ের কাজ ছাগল দিয়ে, ঘোড়ার কাজ গাধা দিয়ে, কুড়ালের কাজ ব্লেড দিয়ে করানো যায় কিনা? করানো গেলেও সেটার গুনগত মান ও ফলাফল ঠিক থাকে কিনা।
 
দুই টাকার লোক দিয়ে দুই লাখ টাকার মানুষের কাজ করিয়ে নেয়া যায়? গেলে সেটার কোয়ালিটি ঠিক থাকে?

৪ লাখ টাকার জি.এম এর দায়ীত্ব ৪৪ হাজার টাকার ম্যানেজারকে দিলে গুবলেট হবে?

কী কী গুবলেট হবে? লিখে ফেলুন।

আমি খুব ওঁচা দু’য়েকটা বলে দিই।

১০ লাখ টাকা বেতনের ডাইরেক্টর ‍যদি ৮০ হাজার টাকার ম্যানেজার দিয়ে রিপ্লেস করেন, তাহলে পরের দিন না হলেও, পরের মাসে, বাথরুমে টিস্যু পাবেন না, আর, চায়ের কাপে আর আগের সোয়াদ পাবেন না। সকালে মন্ত্রী, এমডিকে নিয়ে বিশাল অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দেখবেন, অতিথীদের চেয়ারের অর্ডার দেয়া হয় নাই, মানে চেয়ার নাই। ৩০০ কোটি টাকা ইনভেস্ট করে লেবুর রস চিপার মেশিন কিনে বসিয়ে সেটা ৬ মাস পর চালু করার পর দেখবেন, দুই আঙ্গুলের চিপ দিয়ে মেশিনের চেয়ে দ্রুত আর ভাল রস বের করা যায়। আর, বাজারে কেউ লেবুর রস খায় না। ৩০০ কোটি গচ্চা আর দেড় হালি বড় মাথাকে মাঝরাতে ঘ্যাচাং ফু।

প্রত্যেকের এক্সপেকটেড রোল ও ভ্যালু অ্যাডিশন ভিন্ন। পয়সা বাঁচানোর এই পন্থা দীর্ঘমেয়াদে পয়সা আরও খসাবে। ওহ, ভাল কথা, আগে হতেই মনের মতো লোক বেছে রেখে পরে বিশাল নিয়োগ বিজ্ঞাপন দিয়ে সেই প্রিসেট ডিসিশনকে হালাল রিক্রুটমেন্ট করে চালাবার একটা পুরনো রোগ তো আগে হতেই আছে। মজার বিষয় হল, এই লেখাটির অংশবিশেষ পোস্ট করবার পরে একজন পাঠক আমাকে একটি দারুন চিন্তার খোরাক মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। খুব র‌্যান্ডম একটি শিক্ষা। এজন্যই আমি ক্রাউড লারনিং পছন্দ করি। সেটা হল, ইনটারনাল প্রমোশন ও রিসোর্স রি-এলোকেশনের মাধ্যমে সাকসেশন প্ল্যানিংকে আমরা সর্বৈবভাবে প্রশংসা করি ঠিকই। কিন্তু, এর একটা খারাপ দিকও আছে। যখন জুনিয়ররা জানবে, যে, তার সিনিয়র গেলে তার সিংহাসন পাবার পথ খোলা, তখন সে একদিকে যেমন নিজেকে আপগ্রেড করবার উৎসাহও পায়, আবার, বিপরীত দিকে, বসের বিরুদ্ধে গুটিবাজিকে সে তখন রিলিজিয়াসলি নেবারও প্রেরণা পায়।

বিগত ৯০ দিনে আমি অন্তত ২০ জন মানুষের সাথে কথা বলেছি, যারা অত্যন্ত সিনিয়র এবং যাদের ক্যারিয়ার স্প্যান অন্তত ১৫ বছর হতে ২৫ বছর। তাদের প্রত্যেকে নতুন জব খুঁজছেন আর তাদের সবার কমোন সমস্যা হল, তারা কোথাও হতে আহুত হচ্ছেন না। মানে, এমপ্লয়ারদের ইন্টারভিউ কল তারা পাচ্ছেন না। ভাবতে পারেন, ২০ বছর অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা চাকরি না হোক, অন্তত ইন্টারভিউ দেবার মতো একটা সুযোগও পাচ্ছেন না। তাও আবার সেটা অসংখ্য এ্যপ্লিকেশনের বিপরীতে, একই ধাঁচের পৌনঃপুনিকতায়।

অনেকে আছেন ২০ বছরের ক্যারিয়ার খুব স্বচ্ছন্দ্যে ও তরতর করে সুন্দর গ্রো করে এগিয়ে এসেছেন। হঠাৎ একদিন চাকরি হারিয়েছেন। কিংবা অফিসে এমন একটা গজব নাজিল হয়েছে, যে, চাকরি ছাড়তেই হবে। বিনা মেঘে বজ্রপাত। আর তারও চেয়ে ভয়ানক হল, অভূতপূর্ব, অশ্রূতপূর্ব ও অচিন্ত্যপূর্ব বিষ্ময়ে তিনি দেখছেন, তার মতো ভেটেরানকে কেউ পেতে চাইছেন না। তিনি মার্কেটে ব্রাত্য হয়ে পড়েছেন। চাকরি না পাবার টেনশন যতটা, তারও চেয়ে তার অবাক হবার আঘাতটা বেশি লাগছে। ২০-২৫ বছর ইন্ডাস্ট্রিকে সেবা দেবার পরে, নিজের সেরা যোগ্যতার স্তরটাতে থাকার পর, ইন্ডাস্ট্রি হতে এতদিনের অবদানের সশ্রদ্ধ, সকৃতজ্ঞ ও (প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অতি কাঙ্খিত) প্রতিদান পাবার যখন সময় হল, তখন ইন্ডাস্ট্রি, এখানকার ব্যাপারী-সবাই মিলে তাকে প্রকাশ্য বা গোপনে, সচেতনে বা অবচেতনে বলতে থাকে, ”সুবোধ তুই বৃদ্ধাশ্রমে যা। তুই অবসরে যা।”

এই নয়া বাস্তবতাটা একটা বিরাট রহস্য আমার কাছে। সার্কুলার হচ্ছে, সেখানে তারা সবরকমভাবে ফিট হয়েই আবেদন করছেন। তবু হিট হচ্ছে না, রিচ হচ্ছে না, ভিউ হচ্ছে না, বা ভিউ হলেও তারা ডাকটা তক পাচ্ছেন না। হ্যা, কিছুটা ক্ষেত্রে রেলেভ্যন্স রক্ষা করতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন তা ঠিক। তবে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তারা ঠিকঠাক হয়েও ডাক পান না। এ হতে কয়েকটা এজাম্পশন তৈরী হয়-

ক. হয়তো বাজারে সুযোগ্য প্রার্থী সুপ্রচুর, তাই ক্যনডিডেট পায়ে পায়ে ঘুরছে। (দ্ব্যর্থহীনভাবে বলব, দেশে যোগ্য লোকের সংখ্যা সুপ্রচুর তো নয়ই, বরং কমতি আছে।)
খ. হয়তো এমপ্লয়াররা প্রচন্ড খামখেয়ালিপূর্ণ হায়ারিং প্রাকটিস ফলো করছেন। (তারা ধরবেন পুঁটি মাছ, জাল ফেলেছেন তিমি মাছের।)
গ. হয়তো এমপ্লয়ারদের ATS অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ, যার শিকার হচ্ছে উভয় পক্ষই। (অনেকটা ঘোলা কাঁচের চশমার মতো, আপনি দেখছেন কুয়াশা পড়েছে, অথচ সময়টা চৈত্র মাস।)
ঘ. হয়তো জব মার্কেটে একটা ভূত ঢুকেছে। সেই ভূতটাকে অনেক নামে ডাকা যেতে পারে-সিন্ডিকেট, কোরাম, বিলাতি হেড হান্টিং ফার্ম, স্বদেশী ভাই-বেরাদরদের অন্যায্য অসহযোগিতা, বিলাতি প্রীতি-ইত্যাদি।
ঙ. আর ওসব কিছু না হলে যত দোষ নন্দঘোষ হিসেবে ভাবতে হবে, ওইসব সিনিয়র প্রফেশনালরা সবাই যাচ্ছেতাই ধরনের অযোগ্য। (২০ বছর তাদের যারা কাজ করিয়েছেন, তাহলে তো তাদের যোগ্যতা নিয়েই সন্দেহ জাগবে।)

পারটিকুলার কী হচ্ছে-তা জানি না। আমি অত বড় হাস্তি নই। তাই ভেতরের খবর অত জানব না।

এরকম একটি আপাতঃ স্ববিরোধী অবস্থার কিছু প্রেক্ষাপট ও পশ্চাৎপট আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। বলছি; দেখুন ঠিক বলছি কিনা: –

১. খুব ন্যাচারাল, যে, ক্যারিয়ারটা পিরামিডাল জার্নির মতো। যত ওপরে যাবেন, তত বিপদ বাড়তে থাকবে, ঝুঁকি বেশি, পজিশন কম, বাজার সংকীর্ণ। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাজারে হায়ার পজিশনের জবের সংখ্যা ও ওপেনিং ফ্রিকোয়েন্সি কম। প্রতিযোগীতা বেশি।

২. এটা অতীতেও ছিল, সম্প্রতি বেড়েছে। সিনিয়র এমপ্লয়ীদের পজিশন ও বেতন-ভাতাকে সবসময়ই এমপ্লয়ারদের কাছে ভীতিপ্রদ রকমের বেশি লাগে। ফলে তারা সবসময়েই প্রেফার করেন, সিনিয়র কমিয়ে বা সরিয়ে জুনিয়র নিয়ে/প্রমোট করে কাজ চালাতে। সিনিয়রদের ক্রমবর্ধমান ভ্যালূ এ্যডিশন তাদের বিবেচনায় পাত্তাও পায় না। অতি অভিজ্ঞ প্রফেশনাল তাদের কাছে বুড়ো গাভীর মতো, যেন খাবে সমান সমান, দুধ দেবে কম। অথচ ভাবনাটা হবার কথা ছিল, পুরোনো ওয়াইনের মতো। যত পুরোনো, তত রিচ ও দামী।

৩. চাকরির সিনিয়রিটির সাথে সাথে একর্ডিংলি আপস্কিলিং ও রি-স্কিলিং হওয়াটা সারাবিশ্বে ন্যাচারাল ও স্পনটিনিয়াস হলেও বাংলাদেশে সেখানে একটা প্রশ্ন চিহ্ন রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে কনটিনিউয়াস স্কিল এনহ্যান্সিং বলতে কিছু নেই। আবার প্রফেশনালরাও এই বিষয়ে যথেষ্ট এ্যকটিভ নন। ফলে, সিনিয়রটিকেউ তারা দক্ষতার ক্রমোন্নতি ধরে নেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা যোগ্যতায় অবনমিত হতে থাকেন, নিরবে। ফলে তারা নিজেরাও কিছুটা চ্যালেঞ্জের ভাগীদার।

৪. বাংলাদেশের অর্থনীতি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, বিজনেস কালচার ও ফাইন্যন্সিয়াল প্যাটার্ন অনুযায়ী আমাদের জব ও ট্যালেন্ট মার্কেট আপরাইজিং না। ফলে প্রতি বছর বাড়তি সংখ্যায় ও প্রান্তিক গ্রোথসহ পজিশন প্রপোরশনেটলি বাড়ে না। এতে বাজার স্যচুরেটেড হচ্ছে। কিছুটা শ্রিংকও করছে। বাড়তি সংখ্যক সিনিয়র পজিশনকে ডেপ্লয় করবার প্রশ্ন তখনই আসে, যখন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছর আকারে ও প্রকারে বড় হয়। সেটা না হয়ে যদি নতুন নতুন বিজনেসের সংখ্যা বাজারে বাড়ে, তাতে অন্য লাভ, জুনিয়রদের লাভ হলেও সিনিয়রদের লাভ হয় না। বড় পজিশনকে ডেপ্লয় করবার সক্ষমতায় আসতে একটা নতুন প্রতিষ্ঠানের বহু বছর লাগে।

৫. বিগত বহু বছর ধরে আমাদেরকে ডাহা মিথ্যা কথা বলা হয়েছে উন্নয়ন, গ্রোথ, জিডিপি ও মধ্যম আয়ের। সত্যিটা হল অনেক বছর ধরে সলিড ও জেনুইন গ্রোথ হল্ট হয়ে ছিল। সাম্প্রতিক কিছু বছরে সেটা ডিক্লাইন করে গেছে। বাট আমরা জানতাম (বা জানানো হত) যে জব, মানি ও ট্যালেন্ট মার্কেট বুম করছে। এই মিথ্যাচার রাষ্ট্রীয় ও কর্পোরেটের মিলিত মিথ্যাচার। ফ্যক্ট হল মানি, ফাইন্যান্স, এমপ্লয়মেন্ট ফল করেছে কিন্তু, ফাঁপা আওয়াজ দিয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করে গেছে। তাতে কার্যত জব মার্কেট হল্ট হতে হতে ডিক্লাইন করেছে। ছোট হয়েছে। জিরো হতে নেগেটিভ গ্রোথে গেছে। কিন্তু, একই সময়ে অবৈধ ও অবাধ মানি ফ্লো চলেছে। লুট ও পাচার হয়েছে। যা মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ। ওদিকে বৃষ্টির মতো জেনারেলিস্ট গ্রাজুয়েট পয়দা করা হয়েছে। এগুলোর প্রভাবে চাকরির বাজার কুৎসিত রকম পঁচেছে।

৬. যতটা বাজার আছে, তার মধ্যে টপ ক্লাস জবগুলোর সিংহভাগ বিলাতি কিছু হেড হান্টিং ফার্ম ও বিলাতি বাবুদের স্বজনপ্রীতির কব্জায় চলে গেছে। কিছুটা দেশীয় কোরাম, সিন্ডিকেট ও ‘ভাই’ সংস্কৃতির কব্জায়। বাকিটা সামান্যরকম ওপেন সোর্স হয়ে বাজারে আসছে। ওদিকে আবার পুরো হায়ারিং সেগমেন্টে এমপ্লয়ারদের নানামুখী অসঙ্গত প্রাকটিস বেড়েছে। আমি নিজে দেখেছি, ৪ দফা ইন্টারভিউ হবার পরে বাজারের কংলোমারেট প্রার্থীকে বলেছে, “আমরা আরেকটু ভাবতে চাই এই পজিশনে লোক নেব কিনা।” এপয়েন্টমেন্ট লেটার ইস্যু করে জয়েন করবার আগের দিন এপয়েন্টমেন্ট বাতিল করবার ঘটনাও আকছার। সবকিছুর মিলিত প্রভাবে পুরো ট্যলেন্ট মার্কেটই সাফার করছে। খুব স্বাভাবিকভাবে ঝড় এলে বড় গাছটার গায়ে ঝাঁপটা বেশি লাগবে।

৭. বাজারের টালমাটাল এই অবস্থাতেই সম্প্রতি পরপর ৩টা বড় ধাক্কা গেল-কোভিড, রাশিয়া ভারসাস গোটা পৃথিবীর যুদ্ধ, আর, আমাদের দেশের পট পরিবর্তনের আঁতুড় যন্ত্রণা। সম্প্রতি ট্রাম্পের ভেলকিও যুক্ত হয়েছে। মার্কেট রিকভারি তো দূর, আরও শীর্ন হয়েছে। বিনিয়োগ কমেছে, যা হয়েছে, তা জলে গেছে। নতুনরা বিনিয়োগ করবার সাহস করছে না। টালমাটাল এই সাগরে যারা বড় বড় পজিশনে আছেন, তারা চাকরি বদল করতে খুব কনজারভেটিভলি এগোচ্ছেন। ফলে পজিশন ফাঁকা হচ্ছে না। বাজার সংকুচিত হবার কারনে নতুন নতুন বড় পজিশন তৈরীও হচ্ছে না।

আমার এসব ছেঁদো কথার বিপরীতে আপনি বলতে পারেন, তাহলে লিংকডইনে প্রতিদিন প্রায় তিন গন্ডা করে যে “I am thrilled to share that, I have started my new journey as হেডাপেইচাঁর at অমূক কংলোমারেট” টাইপের পোস্ট হয়, সেগুলো তাহলে কোথা হতে আসে? হ্যা, এত খারাপ বাজারেও প্রায় নিয়ম করে বয়ফ্রেন্ড বদলাবার মতো চাকরি বদল করতে দেখা যায় বটে।

কথা হল, ওই সব নিউ জব জয়েনিং পোস্টের কোম্পানীগুলো একটু ভাল করে দেখে নেবেন। পজিশনগুলোও দেখে নেবেন। কনফিউশনটা কমবে। সোশ্যাল মিডিয়ার চকচকে পোস্টে বিভ্রান্ত হবেন না।

এই যা কিছু বললাম, সবটা খুব আনাড়ি ও কাঁচা চিন্তায় লেখা। বিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞরা আরো গুছিয়ে পশ্চাৎপটটা বলতে পারবেন।

তবে ভেতরে ভেতরে রহস্য যা-ই হোক, শিকার হচ্ছি আমি, আমরা। ২০ বছর চাকরি করে দাড়ি-চুল পাকার পরে যখন আমরা সবথেকে পক্ক, সবথেকে ঝানু, তখনই আমরা বাজারে অপাংক্তেয় হয়ে পথে পথে ঘুরছি। আবার সেই ফ্রেশার জীবনের মতো করে চাকরিতে বড়শি পাতছি, মাছ টোপ গিলছে না। বাজারের সবথেকে পরিপক্ক প্রোডাক্টকে, সবথেকে ভাল অবস্থায় থাকা প্রফেশনালকে উল্টো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সঙ সাজতে হচ্ছে। অতি জুনিয়র এইচ.আর ম্যানেজারের সামনে বসে নিজের ইন্ট্রো দিতে হচ্ছে। নতুন করে ‘ছোনো-পাউডার’ দিয়ে পথে নামতে হচ্ছে। সারাক্ষণ ইয়া নফসি করতে হচ্ছে। অথচ হবার কথা ছিল উল্টো। একজন ভেটেরানের দাম এতই সস্তা এদেশে।

সল্যুশন আমার কাছে চাইবেন না। কারন, আমি নিজেও এর শিকার। আর সল্যুশন দিতে হলে রিজন জানতে হয়। সেটা আমিও জানি না। তবে আন্দাজে যেমন ভূতের বাড়ি ঢিল ছুড়লাম, সেরকম কিছু আন্দাজি আনাজ টোটকা শেয়ার করছি। আপনারা তাবিজ হিসেবে না হোক, পানি পড়া হিসেবে ফুঁ দিতে পারেন।

১. সবথেকে আগে আমি সেই ভিকটিম কাদম্বিনিকেই দায় চাপাবো (”কাদম্বিনিকে মরিয়া প্রমাণ করিতে হইল, যে, সে মরিয়াছে।”), কী আর করা। আমি যদি ২০ বছর চমৎকার ক্যারিয়ার কাটিয়ে থাকি, তাহলে আরো ১৫-২০ বছর আমাকে সেই একই রকম কাজ বা তথাকথিত কর্পোরেট চাকরিই করতে হবে, আর সেটা বাদে অন্যকিছু করা হবে নিজেকে ড্রিগ্রেড করা-এই চিন্তা হতে বের হতে হবে। প্রেস্টিজ ও সামাজিক ট্যাবুকে গুলি মারুন। দারুন একটা কর্পোরেট ক্যারিয়ার কাটানো তো হল। শেষ ১৫ বছর যদি আপনি একটা মুদী দোকান চালান, কার কী বলবার আছে? কে বলেছে, কে ঠিক করে দিয়েছে, যে, আপনাকে আজীবন গলায় রশি (টাই) বেঁধে মতিঝিলে ভাতের বড়িই বেচতে হবে? আপনার মনের অবচেতনে হয়তো একটা সংকোচ ও চোরা ভয় কাজ করবে, “কেউ যদি দেখে ফেলে, যে ওয়ালিদ সাহেব এখন মুদী দোকানদার?” আরে ভাই, ওই ‘কেউ’ টা কে? সে আপনার কে? সবকিছু করবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করুন নিজেকে।

২. জবেই যদি থাকতে চান, তাহলে সো কলড র‌্যাংক ও স্টাটাস ছাড়ুন। এবার বাকি ১৫ বছর ব্যাসিক জীবন চালিয়ে নেবার মতো জব করলে অসুবিধা কী? প্রথম ২০ বছর ভবিষ্যতের চিন্তা ছিল। এই ১৫ বছরে তো আর সেটা নেই, কারন, এই ১৫ টাই তো ভবিষ্যত। তাই এখন ব্রেক ইভেনে চললে ক্ষতি কী? আপনি যে কম দামে ও লো প্রোফাইলে বিক্রী হতে আগ্রহী সেটা স্মার্টলি ব্যক্ত করুন এবং সেটা এমপ্লয়ারকে কীভাবে বেনেফিটেড করবে-সেই ব্যাখ্যা মনে মনে রেডি রাখুন। আমি বলছি না ডিগ্রেড হতে, বলছি রেডি থাকতে।

৩. যেসব স্থানে এপ্লাই করছেন, তাদের এইচ.আরকে লাজ শরমের মাথা খেয়ে এপ্রোচ করুন সরাসরি। মেসেজের রিপ্লাই না দিলে ফোন করবেন। ছোটরা পাত্তা না দিলে বড়দের করবেন, বড়রা না দিলে ছোটদের। মনে রাখবেন, আপনি অপরাধ কিছু করছেন না। বরং, তাদের অসঙ্গত প্রাকটিসের দায় বহন করছেন আপনি।

৪. প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মেসেজ করুন, মেইল করুন। কারন, দেখবেন, অধিকাংশ স্থানেই সূর্যের চেয়ে বালি গরম। মালিকের চেয়ে এইচ.আর গরম।

৫. রেজুমে ঠিকঠাক করুন। ওটা আপনার প্রাথমিক অস্ত্র। ওটাতে শান দিন। ভেটেরান-এই জাত্যাভিমান নিয়ে আজীবন রেজুমেতে নজর দেননি। এবার দিন। ওটা ATS Friendly কিনা-তা চেক করে ব্যবস্থা নিন। অনেকেই ভেবে বসে থাকেন, তার রেজুমে ঠিক আছে। আমি দেখতে পাই, ঠিক নাই। ঠিক নাই মানে হল, আপনার প্রফেশনাল এভাটার, যেমনটা ওতে দেখাবার কথা, তেমনটা দেখা যায় না। একই সময়ে লিংকডইন প্রোফাইল সার্বিকভাবে অপটিমাইজড ও স্মার্ট করুন।

৬. ট্রান্সফরমড ক্যারিয়ার খুঁজুন। মানে, একই স্কিল, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করা যাবে-এমন জব, তবে অন্য ধরনের দায়ীত্ব। যেমন: ধরুন, আপনি ছিলেন ক্রিকেটার। এবার আপনি ক্রিকেট কোচ হোন। আপনি ছিলেন ইংরেজির টিচার। এবার আপনি ইংরেজিতে কলাম লিখুন। বা ইংরেজি পাতার এডিটর হোন। অনেকে কনসালট্যন্সি করতে উপদেশ দেবেন। করতে পারেন। যদি খুব ভাল মার্কেটিং জানেন। অন্যথায় ক্ষ্যামা দিন। বাংলাদেশে জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা খুবই অনাকাঙ্খিত ও ধূচ্ছাই টাইপের পণ্য।

৭. থার্ড পার্টি হেড হান্টিংয়ের হর্তাকর্তাদের সাথে নতুন করে দহরম মহরম বাড়ান। তাদের অফিসে চা খেতে যান। তাদের চা খেতে ডাকুন। লিংকডইনে বড় বড় হাস্তিদের তেল দিন। ছোট ছোট তেলাপোকাদের মবিল দিন। নেটওয়ার্ক বাড়বে। তেল দিতে যদি মন সায় না দেয়, তাহলে মুদী দোকানে তেল বেচুন। কী বললেন, প্রেস্টিজ? একটু আগেই না বললেন, তেল দিতে পারবেন না? আবার সেই আপনি যদি পাছে লোকে কিছু বলাকে ভয় পান-তাহলে কেমন হয়ে গেল না?

৮. লিংকডইনে নিয়মিত জব পোস্ট করেন-এমন ব্যক্তিদের সাথে সংযুক্ত হোন। হোয়াটসএ্যপে বিভিন্ন টারগেট ও পারপাস বেজড গ্রুপে যুক্ত হোন। অনেকেই মনে করেন, বড় বড় ব্যক্তিদের সাথে যুক্ত হওয়া বেশি কাজে দেবে। নাহ, ভুল। বরং, ছোটরা আপনাকে এই কাজে তবুও কিছু সাহায্য করবে। যত সিনিয়র হবে, অন্যকে সাহায্য করার হার তত কম হবে।

৯. সম্ভব হলে নামের আগে ও পরে গন্ডাখানেক ডিগ্রী বা সার্টিফিকেশন লাগাবার ব্যবস্থা করুন। রিয়েল তকমার কথা বলেছি কিন্তু, ফেইক কিছু যেন না হয়।

১০. একদম জবলেস হলে লিংকডইনে পোস্ট দিন। চমৎকার ও প্রফেশনালভাবে। সেই সাথে লিংকডইনে নিয়মিত হোন। নিয়মিত ভাল পোস্ট করুন। এনগেজ হোন অন্যদের সাথে। লিংকডইন, বিডিজবস ও অন্যান্য সাইটগুলোর জব এলার্ট ওপেন করে নিন।

১১. ২০ বছর ক্যারিয়ার হয়ে গেলে ২০২৫ সালের বাংলাদেশে অরগানিক রিচ, ক্লিক, হিট, নেটওয়ার্ক অকেজো। সনাতনি দিনের মতো বিডিজবসে বা মেইলে আবেদন করলে ইন্টারভিউ কল আসবে-সেটা সম্ভব হলেও খুব ক্ষীণ। তাই নন-অরগানিক যা মাথায় আসে করুন। সাবেক সহকর্মী, চেনা মানুষদের নক করুন। নিজ প্রফেশনের মানুষরাই আপনাকে এরকম আরেকটা জবের জন্য তথ্য সবথেকে বেশি দিতে পারবেন। তবে এর বাইরে যে প্রফেশনের মানুষকে বেশি নক করবেন, সেটা হল এইচ.আর। এঁদের কাছে সবার পেটের খবর না থাকলেও হাঁড়ির খবর তো কিছুটা থাকেই।

ভাল কথা, এইসব টোটকা তখনই কাজে দেবে, যখন আপনি অনুধাবন করবেন, যে, ক্যারিয়ারের জিরো আওয়ার হতেই পরিকল্পিতভাবে, ধাপে ধাপে ও ধারাবাহিকভাবে এগোনো উচিত ছিল অথচ, সেটা আপনি করেননি; আর, আপনাকে আপনার যাবতীয় দায়ীত্ব ও খরচের খাতগুলোকে নিয়মতান্ত্রীক, নির্মোহ, পরিকল্পিত ও যৌক্তিকভাবে সাজাতে হত, যা আপনি করেননি; আর, সন্তানদের দাড় করানো, বাড়িঘর কেনা ও তার দেনা, আলগা বিলাস বা সামাজিকতা এসবের অভিঘাত-এসব কিছুকে নিয়মের মধ্যে রাখার ছিল, যা না রেখে ভুল করেছেন। ক্যারিয়ার একটি চলমান, ধারাবাহিক, দীর্ঘ যাত্রার ও পরিকল্পনার নামান্তর। এখানে মেটিকুলাসলি না ভাবলে ও চললে তার ফলাফল ভুগতে হবেই। কারো বেশি, কারো কম। প্রথম হতেই নিখূঁত পরিকল্পনা মেনে চলবার ক্ষেত্রে যদি আপনার খামতি থেকে থাকে, তার অভিঘাতটুকু মেনে নিয়ে নতুন করে ভাবুন। ওটার জন্য আপনাকে পে-অফ করতেই হবে। যখন আপনি জুনিয়র অফিসার, তখন প্লেনে চেকইন দিয়েছেন, বালি-পাতায় ঘুরেছেন। অতি বিপ্লবী মোটিভেশনাল স্পিকারদের ফেরেবে পড়ে। সেক্ষেত্রে বৃদ্ধ বয়সে আপনাকে পাবলিক বাসে গুলিস্তান-মতিঝিল করতেই হবে।

একটি বড় সংখ্যক মানুষ সন্তানদের জন্য পুরোটা জীবনই উৎসর্গ করেন। তাদের প্রায় ৩০ বছর তক প্রোভাইড করার চেষ্টা করেন রাজার হালে রেখে। তারও পরে যাতে বাপের মৃত্যুর পরে তারা ভোগ করতে পারে, সেজন্য বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি, ডিপোজিট, বিলাত গমন, বড় ঘরে বিয়ে, গাড়ি-এসব আয়োজন করে রেখে যাবার দায়ও পিতা-মাতা নেবার চেষ্টা করেন। সেটা ভুল।

আমি মনে করি, সন্তানদের ১৮ বছর (বাংলাদেশে হয়তো ২৩ বছর) তক চালিয়ে নেয়া, শিক্ষার ব্যবস্থা করা আর ১৮ পার হলেই যাতে নিজের দায়ীত্ব নিতে পারে, সেজন্য ছোট হতে রেডি করা উচিত। আপনার যখন ২০ বছর ক্যরিয়ার, তখন তার বয়স হবার কথা অন্তত ১৫। বড়জোর তাকে আর ৩ বছর প্রোভাইড করবার চাপ নিন। তারপর তার ১৮ হলে কেবল নিজেকে নিয়ে চলতে যতটা লাগে-ততটা আয় করবার প্ল্যানে নিজেকে সীমিত করুন। নিজের ভবিষ্যতের জন্য ২০ বছর কাজ করলেন। এখন সন্তানের ভবিষ্যতও আপনি ভেবে রাখবেন আর নিজেকে কোরবাণ করবেন? আজীবনই গ্রোথ ও ভবিষ্যতের জন্য ভেবে বড় হতে বড় জবে দৌড়াতে হবে-এটা ভুল।

আপনার জন্ম চাকরি করে মরার জন্য হয়নি। চাকরি আপনার কোর অবজেকটিভ ও পারপাস সার্ভ করবার একটা মাধ্যম মাত্র।


পিঠ চুলকোনোর কর্পোরেট তরিকা শিখে নিন: পেশা হিসেবে কনসালট্যন্সি ও ট্রেনিং এর দৌড় জেনে নিন

পিঠ চুলকোনোর একটি অদ্ভূৎ প্রথা আছে এই দেশে।

সম্প্রতি এক ভদ্রলোকের সাথে চলতি পথে এই পিঠ চুলকোনো মেথড এবং বাংলাদেশের পেশাজীবি ও কর্পোরেট জগতে তার বহুল চর্চা নিয়ে কথা হচ্ছিল। তারই আলোকে এই বচনামৃতের জন্ম। তার নাম বললে আমার চাকরি থাকবে না আর ওনার চাকরি হবে না। তাই চেপে গেলাম।

চেপে যাবার আর ফেসবুকে চাপ দেবার একটা বড় সমস্যা হল, এখানে আপনি বেনামে কিছু লিখুন। আপনার ১০০% পাঠক ও সুহৃদ, আপনি না চাইলেও এবং একদম পবিত্র মনে কাউকে মনে না করে লিখলেও প্রত্যেকে, হ্যা, প্রত্যেকে মনে মনে অফেনডেড হবে ও ভাববে, “হালায় কি এই কতাডা আমারে ভাইব্বা কইল? এগলার সবগিলিই তো দেহি আমার লগে মিল্লা যায়।”

জনপ্রিয় অভিনেতা, গীতিকার জনাব মারজুক রাসেলের একটি কবিতার লাইনের কথা একবার শুনেছিলাম-

”তুই করবি, আমি পাহাড়া দেব,

আমি করব, তুই পাহাড়া দিবি।”

পিঠ চুলকানোতে আসি।

প্রফেশনাল ও কর্পোরেট এরেনায় প্রতিষ্ঠা, মার্কেটিং, ব্র্যান্ডিং ও রিকগনিশন এক মহালোভনীয় মাদক। প্রত্যেক প্রফেশনালই এর পূজারী। স্বীকৃতি আর প্রাপ্তির নেশায় বুঁদ আমরা সব প্রফেশনালরা। এই নেশাকে কাজে লাগায় আবার উদীয়মান উদ্যোক্তা, জননেতা, কর্পোরেট নেতা, সংগঠক, চিকামারা সমিতি, ভূঁইফোড় ক্লাব, অমুক ভাই জিন্দাবাদ, one man army প্লাটফরম-এরা। এনাদের পয়সা নেই, ফান্ড, স্পন্সর নেই। অথচ ওপরে উঠতে হবে, মার্কেটে জানান দিতে হবে, বাজার দখল করতে হবে, পসার বাড়াতে হলে প্রচুর ইভেন্ট করতে হবে। বাজেট নেই-তাহলে উপায়?

বড় বড় স্যার ও স্টাররাতো এদের ডাকে সাড়া দেবেন না। এরা তখন খোঁজে আমার মতো উদীয়মান, সুযোগসন্ধানী কিন্তু অ-প্রতিষ্ঠিত ওয়ায়েজিন পেশাজীবিকে। যাদেরকে হায়ারে খেলতে, স্যরি, বকবক করার জন্য আনতে পয়সা দিতে হয় না। গাড়ি পাঠাতে হয় না। বেশি তেল দিতেও হয় না। সামান্য হাড্ডি নাড়িয়ে ডাকলেই আমরা খুশিতে বাকবাকুম হয়ে দৌড় দেব। কেন দেব? কী সেই রহস্য?

স্বীকৃতি আর নারায়নের লোভে লালায়িত আমরা, যারা এখনো উদীয়মান পেশাজীবি, যারা এখনো ঠিক স্টার বক্তা বা কী/লিড হয়ে উঠিনি, যাদের বাজার কাটতি কম, তারা মাগনা, নিজের পকেটের পয়সায় বাস ভাড়া বা সিএনজি ভাড়া দিয়ে, ভুঁইফোড় সংগঠন বা প্লাটফরমের ডাকে টকশো, কী/লিড স্পিকার, এনালিস্ট, সাইড বক্তা, ভ্রাম্যমান নিশীকন্যার মতো ভ্রাম্যমান এক্সপার্ট, বিজ্ঞ প্যানেলিস্ট হবার ডাক পেলে বর্তে গিয়ে যোগ দিই। দিন শেষে এক প্লেট কাউয়া বিরিয়ানী বা কাঠের টুকরার ক্রেস্ট বগলে নিয়ে বাসে করে বাসায় ফিরি। কারন, বাজার পেতে হবে যে, খোমা চেনানোর ও বিনা খরচে ব্র্যান্ডিং পেতে হবে যে।

উদীয়মান সংগঠন আর উদীয়মান সেলেব-উভয়ের মধ্যে তাই কাস্টিং কাউচের মতো পারস্পরিক সম্পর্ক। যাকে বাংলায় বলে পিঠ চুলকোচুলকি সম্পর্ক। পরস্পরের পরস্পরকে দরকার। বিনা খরচে ওঁরা পেয়ে যায় লীড বা সীসার বক্তা। ব্র্যান্ডিংয়ের জোরে তাকেই বানিয়ে দেয় কর্পোরেট এরেনার গুফতি টাহেরি। ওদিকে গুপ্ত দা, তথা গুপ্তি টাহেরিও ব্র্যান্ডিংয়ের তাড়না হতে চিকামারি সমিতির ডাকে ওয়ায়েজিন হয়ে এক পেট বিরিয়ানীতেই ঘন্টা খানেক ম্যাৎকার করে কাষ্ঠ নির্মিত ক্রেস্টে খুশি। তৃপ্ত। পুরোই পিঠ চুলকোনো মেথড।

Industry-Academia collaboration নামে আরেকটা ফাজলামো আর মজাকি শুরু হয়েছে অনেক দিন হল।

ওই যে, কে যেন একদিন কোথায় বলেছিল, শিল্প ও কর্পোরেটের বোদ্ধাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে একাডেমিতে সংযুক্ত না করতে পারলে জাতির নির্বান নেই।

অমনি, জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফলাফল,

হঠাৎ হঠাৎ করে একাডেমির মনে পড়ে, আরেহ, এই ব্যাচটার Industry-Academia collaboration তো করা হয় নাই। অনেকটা যেন বিষয়টা খতনার মতো।

তখন তাড়াহুড়ো পড়ে যায়। হরবর করে কোনো একজন শিল্প বা কর্পোরেট বোদ্ধাকে সনির্বন্ধ বা ডলারবন্ধ অনুরোধ করে ধরে আনা হয়।

তিনি ঘন্টা দুয়েক লেকচার দেন, কাঠের টুকরো সমেত ছবি তোলা হয়।

ব্যাস, Industry-Academia collaboration এর নির্বান হয়ে যায়।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি ব্যাচের Industry-Academia collaboration করার জন্য জনৈক ভদ্রলোক ফোন দিলেন। বললাম, শনিবারে করতে হবে, কারন, অন্য দিনগুলো আমার নয়, আমার নিয়োগকারীর প্রাপ্য। তিনি জানালেন, শুক্র শনিবারতো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ওই দিনতো কেউ আসবে না। দেখি, কী করা যায়। তিনি আর দেখেন নাই। অথবা, অন্য মুরগী পেয়ে গিয়ে থাকবেন।

ভাবুন, জ্ঞানান্বেষন করব, তবে সেটা আর সব আরাম নিশ্চিত করে। সাপ্তাহিক ছুটিতে শিখব না, লাগলে মাস্টার মশাই তথা Industry-Academia collaborator (কোলাবোরেটর নাকি রাজাকার) তার অফিস কামাই দিয়ে হলেও আসবে আর দেশকে উদ্ধার করবে।

এই দেশে সবকিছু নিয়েই মজাকি

শেখা ও শেখানো-উভয় তরফেই বাংলাদেশ এক হতাশার নাম। কেউ শিখতে চায় না, কেউ শেখাতে। শিক্ষা, শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ বিক্রী এখানে এক মামদোবাজি।

যেই দেশে সামান্য হ্যন্ড নোট যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা হয়, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে, সেখানে প্রশিক্ষণ একটা ব্যবসায়ীক পণ্য হয়ে ওঠার চান্স কম।

কখনো কখনো  আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা নোট বই বা হাতে লেখা নোট চাইলে সেটা যক্ষের ধনের মতো লুকোতেন, নানা অজুহাতে দিতেন না, তারা সেই যক্ষের ধন নোট পড়ে আজকে কে কে আইনস্টাইন, বিল গেটস, জুকারবার্গ, অমর্ত্য সেন কিংবা জবাইদেন হয়েছেন। সেই সাথে আরেকটা জিনিস জানতে ইচ্ছে করে। প্রফেশনাল জীবনের শুরু হতে আধবুড়ো হওয়া তক বিভিন্ন সভা, সমিতি, সেমিনারে, ট্রেনিং প্রোগ্রামে গিয়ে মূল কাজে মনোযোগ দেবার বদলে মানুষের ঘাড়ের ওপর দিয়ে, দশজনকে বিরক্ত করে পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইডের ছবি তোলা আর অনুষ্ঠান শেষে পিপিটির কপি পাবার জন্য যারা হামলে পড়তেন, সেই পিপিটি আর ছবিগুলো নিয়ে তারা অস্কার জিততে না পারুন, অন্তত ঘরে ফিরে জীবনে আর কখনো পিছু ফিরে সেগুলো আরেকবার দেখেছেন কিনা।

কয়েকদিন আগে একজন ট্রেনিং প্রফেশনাল কাম বিজনেসম্যানের সাথে কথা বলছিলাম। হ্যা, আমি যে কোনো জিনিস বিক্রী করা বা বিনিময় মূল্য নিয়ে লেনদেন করাকে বেঁচাকেনা বা ব্যবসাই বলি। এই বিষয়ে আগেও অবশ্য শেয়ার করেছি। ওনাকেও করলাম কথাচ্ছলে, যে, বাংলাদেশে ট্রেনিং, স্কীল এনহ্যান্সমেন্ট বা ডেভেলপমেন্টকে পেশা হিসেবে নেবার বাজার কতটা? কতটা ভায়াবল? ট্রেনিং পণ্য হিসেবে কতটা ভায়াবল? ট্রেনার প্রফেশন কতটা পোটেনশিয়াল?

আমার ব্যক্তিগত ধারনা হল, বাংলাদেশ ট্রেনিং ও স্কীল কোচিংয়ের জন্য এক জীবন্ত চিতা বা নরক। হাতে গোণা কিছু নমস্য ব্যক্তিত্ব বা শুরুর দিকেই প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন-এমন কিছু ব্যক্তিত্ব বাদে হাল জামানায় বাজার পাবার চেষ্টা করছি বা করছেন, মানে নয়া আদমী ট্রেনার বা স্কীল কোচদের জন্য বঙ্গদেশ সাক্ষাত এক হতাশার সাহারা। এই দেশে ট্রেনিং/স্কীল কোচিংয়ের ভাত যতটা আছে ও ভবিষ্যতে থাকবে, তাকে বলা চলে ‘কাবিখা’, মানে কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রোগ্রাম। হচ্ছেও তাই।

আপনি ১৫ বছর ধরে একটি স্কীল অর্জন করবেন। পাবলিক সেটাকে মাগনা পেতে চাইবে। আপনাকে ব্র্যান্ডিংয়ের মূলা দেখিয়ে বক্তা হিসাবে নিয়ে যাবে, ১৫ মিনিটের বক্তৃতা দেবেন, এক প্যাকেট বিরানি খাইয়ে একটা কাঠের টুকরো হাতে ধরিয়ে বিদায়। এটাকে তো কাবিখাই বলে।

সেদিন আরিফ ভাই আফসোস করছিলেন, কষ্ট করে রক্ত ঝরিয়ে এ্যাংকরিং শিখেছেন। পাবলিক মাগনা উপস্থাপক হতে ডাকে। এমনিতে আমাদের শেখা ও শেখানোর অভ্যাস নেই। ওটা আমাদের কালচারেই নেই। এখানে কেউ শিখতে চায় না। ঠিক যেমন এই দেশ ইতিহাস হতেই শিক্ষা নেয়নি। আপনি নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে শেখানোর জন্য ডাকবেন-পাবলিক খাবে না। সন্দেহ করবে।

একই সাথে আবার এটাও সত্যি, বাঙালীরা শেখাতে চায় না। নিজে কিছু জানলে সেটা স্কুলে পড়বার সময় যেমন নোট লুকিয়ে রাখতাম, তেমন রেখে দিতে চায়। এমনিতে আমাকে নিজের ফ্যান, পাঙ্খা, অনেক কিছু বলা অনেককে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক কিছু শেখানোর জন্য অনুরোধ করেও সাড়া পাইনি। এমনকি সেলেব দেবতাবৃন্দ ন্যুনতম guidelines বা mentoring টাও করতে রাজি না। তার ওপর আছে ট্রেনার ও মেনটরের দলাদলি, কোরাম, ফোরামের জ্বালা।

আপনি ওই কোরামের ছাত্র হলে এই কোরামে দুই দুগুনে চার শিখতে চাইলেও শেখানো হবে না। হ্যা, কেউ কেউ আছেন বটে, তবে সেটা সাগরে এক ফোটা চিনির মতো। দু’দিন আগেই একটা গল্প বলেছিলাম, সেটা আরেকবার স্মরন করি। স্বীকৃতি ও সুনামের নেশা মাদকের মতো। যার জন্য প্রফেশনালরা জীবনও দিতে রাজি। স্বীকৃতির এই ঘ্যানচক্করে নেহাতই ব্রাত্য RMG HR

যত যা-ই করুন, যত প্রাজ্ঞই হোন, আপনি এমনকি একজন veteran ও যদি হন, নিখীল বঙ্গ প্রফেশনাল সমিতি HR Pro হিসেবে আপনাকে স্বীকৃতি দেবে না। এই দ্বিতীয় গল্পটার জন্মও ওই জনৈক জুনিয়রের সাথে খোশালাপের সময়। নাম বললে চাকরি তো চাকরি, ওজুই ভেঙে যাবে। তাই বললাম না।

আপনার মেনটর কে? পেশাগত মেনটর ও ব্যক্তিগত মেনটর? বলবেন?

আমাদের সারাটি জীবন আমরা নেটওয়ার্ক, রেপো, পিয়্যার, কানেকশন, ফ্রেন্ডস, মেনটরস বানাতে ও বাড়াতে এফোর্ট দিই। বিশেষত প্রফেশনাল এরেনাতে বড় ভাই, বদ্দা, ভাইয়া, বস, ছ্যাড়-এর বহর বড় করতে আমরা সম্ভব-অসম্ভব, দৃষ্টিনন্দন ও দৃষ্টিকটু-অনেক রকম চিৎপাত চেষ্টাই করে যাই। উদ্দেশ্য একটাই-সময় হলে বদ্দা যদি দয়া করে একটু ঠুকে দেন; যদি যায়গামতো বদ্দা একটু হুকে দেন; যদি একটা মূলা উন্মুক্ত হলে ‘ভাইয়া’ সেটা আমার কপালে ফিকে দেন।

এই আশায় আমরা কত কীই না করি। পারলে বাসা হতে গরম পরোটা বানিয়ে ভাইয়াকে খাওয়ানো হতে সহমত-রহমত ভাই, এসোসিয়েশনের ভোটে ভোটাই ভাই, ফেসবুক পোস্টে লাইকাই, বিরুপ মন্তব্যকারীকে পেটাই-কত কত এফোর্ট দিয়ে আমরা কর্পোরেট বড় ভাই গড়ে তুলি আর তাকে লালন করি। দুধের গরু পালার মতো। বাস্তবতা হল, এই বড় ‘ভাইয়া’ আপনার কাজে আসে ঘন্টাটা। আপনার সুস্বাদু আলু পরোটা বা বাড়ি হতে আনা লাল জাম আলুর সদ্ব্যবহার আর আপনার ভোটে ক্লাব বা সমিতির পিরসিডিন হওয়ার বাইরে আপনার আর কোনো প্রাপ্তি জীবনে সত্যিই ঘটবে-সেই আশায় থাকলে আপনি অপেক্ষায়ই থাকবেন-নাজিরের মতো।

আপনাকে সত্যি সত্যি যদি কিছু বা কেউ গাছে তুলতে পারে-সেটার নাম যোগ্যতা, যা আপনাকে আত্মশক্তির বলে সমুন্নত রাখে। বড় ভাইয়া, ভেউয়া, দাদা, সহমত ভাই, ম্যানটোর, ছিঃনিয়র আর বসরা কখনো কারো নির্বান প্রাপ্তিতে ভূমিকা রেখেছেন-এমন যদি কেউ এই লেখা পড়ে থাকেন, তাহলে কমেন্ট বক্সে সামান্য পদধুলি দিয়ে যাবেন। আমি মাদুলি কবচ করে কোমরে কাইতন দিয়ে ঝুলিয়ে রাখব। আর অমন মাদুলির সংখ্যা যত বেশি হবে (বেশি বেশি লোকের পজিটিভ প্রাপ্তিজনিত পদধুলির আধিক্যে) আমার তত লাভ। মানে, সমাজে বিদ্যমান ‘ভাইয়া’দের প্ররোচনায় পাবলিক ক্ষেপে গিয়ে আমার লুঙ্গী ধরে টান দিলে মাদুলিগুলো তখন রক্ষাকবচ হয়ে লজ্জা বাঁচাতে পারে।

কীভাবে সফল হবেন, কীভাবে বড় হবেন-এই মন্ত্র ও তাবিজ বিক্রী করেই বড় হয়ে যাচ্ছেন অনেকে। নিজে বড়লোক হতে না পেরে অবশেষে, ”বড়লোক হবার ৫০১ টা উপায়” বই লিখে কোটিপতি বনে যাবার মতো।কয়েকদিন আগে দেখলাম, একজন উদ্যোক্তাকে, যাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার প্রতিষ্ঠান কী করে, আর উত্তরে তিনি বলেন, ”যেসব সংগঠন নারীদের নিয়ে কাজ করে, আমি সেসব সংগঠনকে নিয়ে কাজ করি।”

আজ দেখলাম, এক ছেলে, পড়াশোনায় লবডঙ্কা, পাশ করে অন্য কিছু করেনি। সোজা আসল লাইনে চলে গেছে। কী সেই লাইন? তিনি লাইনে নতুন আসা, মানে সদ্য যুবা, তরুণ বেকার আর চাকরিপ্রার্থীদের ফুফু ও ফুফা বনে গেছেন, মানে ফ্রেশারদের ফু দেন, মানে ‘কীভাবে সফল হবে, কীভাবে বড় হবে, কীভাবে দাড়াবে’ তার মন্ত্রণা দেবার তাবিজ ও মাদুলী বিক্রীর মাজার চালান।

ফুঁ-ফাঁর কবিরাজি হতে যুগের পরিক্রমায় আজকের কনসালট্যন্সি-অনেকের মতে আমাদের প্রফেশনের ভবিষ্যত এটা। যেততেন ভবিষ্যত না। বেছে নেয়া ভবিষ্যত না। যখন বাজারে আর বিকোবো না, তখনকার অবলম্বন এটা। আমি এই ধান্দাতেও আশা দেখি না। কেন দেখি না, সেটা একটু ভেঙে বলি।

ভাতের চেয়ে ডাল উঁচু:

বুড়ো বয়সে চাকরী চলে গেলে বা চাকরিতে কেউ না পুঁছলে কী করে খাব-যখনই কোনো জেষ্ঠ্যতাতকে এই প্রশ্ন করি, তারা পরামর্শ দেন,

”ভাই, লেখালেখি বাদ দ্যান। কনসালটেন্সির চেষ্টা করেন।”

আমি প্রশ্ন করি, কনসালটেন্সী যে করব, নিজেই তো কিছু জানি না। শুনে তারা অর্থপূর্ন একটি হাসি দেন। যার অর্থ হতে পারে দুই রকম-

এক; মিয়া, কিছুই যখন জানো না, তখন ফেসবুকে এত রাজা উজির কেন মারো?” কিংবা, “তুমি যদি কিছুই না জেনে থাকো, তাহলেই তুমি কনসালটেন্সি করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।” হা হা হা হা [মজা করলাম।

আমার শ্রদ্ধেয় স্যাররা দয়া করে বিষয়টিকে মজা হিসেবেই নিন। আর অবশ্যই “সবাই এক না।”]

সরকারী অফিসের দূর্নীতি নিয়ে এই দেশের প্রত্যেক ফেসবুকিয়ান ও জাগ্রত জনতাসহ নানা পদের দেশী বিদেশী সংস্থা অত্যন্ত সোচ্চার। যদিও সামাজিক মাধ্যমে দূর্নীতি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার একটি বড় অংশই উৎসারিত হয় এই আফসোস বা হিংসা হতে, যে, “ঈশশশশশ, ও ই কেন? আমি কেন নয়!” যাহোক। নিয়ত গুনে বরকত।

তা, এই জাগ্রত জনতা ও নানা রকমের জনহিতৈষী লাতি ও বিলাতি সংগঠনগুলো কি জানে বা জেনেও না জানার ভান করে, যে, খোদ তারা নিজেরা এবং এই দেশের বিশাল সংখ্যক লাতি ও বিলাতি দাতব্য, সুশীল সংস্থা প্রচন্ড রকম ধান্দাবাজ ও দূর্নীতিবাজ?

এই দেশ যেহেতু গুজব, রব, হাইপ, ভাইরাল, সেলেব, প্রচারেই প্রসার নির্ভর একটি আজব দেশ, এদেশে সবাই তাই বরাত গুনে করে খাচ্ছে। দু’হাতে সমানে দুইয়ে নিচ্ছে সুযোগ নামক কামধেনুর স্ফীত বাট হতে। আজ একজন প্রখ্যাত ’দাতব্য’ কনসালটেন্ট সাহেবকে বহুদিন পরে সামাজিক মাধ্যমে দেখে একটি কথা মনে পড়ে গেল।

আমি আমার চাকরী জীবনের এক যুগেরও বেশি সময়ে ছোট বড় নানা রকম লাতি ও বিলাতি ‘দাতব্য’, ‘সুশীল’, ‘জনদরদী’ জনহিতৈষী সংস্থার সাথে কাজ করেছি। তা করুন ওনারা জনহিতৈষ। সমস্যাটা হল, ওনারা জনহিতৈষের জন্য বিলাত ও দেশীয় খাত হতে যে বিপুল পরিমান অর্থ বাগিয়ে থাকেন, তার বিপুল অংশই ওনারা ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, দলগত ও সংস্থাগত পকেটে পকেটস্থ করে থাকেন। অর্থ পকেটস্থ করার একটি বড় মাধ্যম হল প্রজেক্ট। আর সেই প্রোজেক্ট নামানোর জন্য আবার থাকেন কনসালটেন্ট। উভয়ে উভয়কে পিঠ চুলকান। দুয়ে মিলে লীন হন।

মাঝখান হতে দুই মাস, ছয় মাস, নয় মাস মেয়াদী নানা আজগুবি প্রোজেক্ট ল্যাপটপ হতে মাঠে নামিয়ে টাকা বগলদাবা করে কনসালটেন্ট ও প্রোজেক্ট-উভয়ে আল বিদা।

প্রোজেক্টের জন্য গাড়ি, বাড়ি, প্রি-এসেসমেন্ট, পোস্ট-এসেসমেন্ট, কনসালটেন্ট, সেমিনার, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, মনিটরিং ব্যায়, প্রোমো, বিদেশ ভ্রমন-কত কত খাত যে তৈরী হয়। দুঃখীর দুঃখ নিবারনীর জন্য নড়ে চড়ে বসার ব্যয়ের পেছনেই দাতব্য খাতের ৮০ শতাংশ খেয়ে নেয় সংস্থাগুলো। দুঃখী মানবতার হাতে যত টাকা পড়ে, তাদের টাকা দেবার দায়ীত্বে থাকা খাদিমদারদেরকে পালতে তার দশগুন পয়সা খরচ করতে হয়। তিন টাকা ডোনেশন, ডোনারের ফুলের মালা আর ডোনার ক্লাবের কেরানীকে পালতে খরচ তিনশো টাকা।

আমি আমার সারা কর্মজীবনেই এমন গন্ডা গন্ডা প্রোজেক্ট গিলতে বাধ্য হয়েছি সুশীলদের ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের আগ্রহের চাপে। ফলাফল এমনকি শূন্যও নয়। কারন ফলাফল কাম্যইতো ছিল না। মাঝখান হতে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ওইসব প্রোজেক্টের শিকার-মানে স্টেকহোল্ডার বা সার্ভিস রিসিভার-তারা ও তাদের লোকজন মাস কয়েক ধরে উদয়াস্ত নিজেদের জরুরী কাজকাম বাদ দিয়ে ওনাদের নানা সেবা ও সমন্বয় দিতে দিতে গলদঘর্ম। তারপর মাস ছয়েক পরে তারা গায়েব। কনসালটেন্ট, প্রোজেক্ট কোর্ডিনেটর সাহেবরা ততদিনে অন্য নতুন প্রোজেক্টের মহান তদারকিতে ব্যস্ত ও ন্যস্ত।

ফোন করলে বলবে, “ওয়ালিদ সাহেব, আমি কার আমি কার, কে তোমার, কে তোমার?” কিংবা ‘রঞ্জনা, আমি আর আসব না।” গার্মেন্টস সেক্টরে যারা কাজ করেন, তারা ভাল জানবেন, বিশেষভাবে গত ২০১৩ সালের পর হতে গার্মেন্টস সেক্টরকে টার্গেট করে কোটি কোটি টাকার জনহিতৈষী দাতব্য অথবা দাঁতে কাটতব্য হিসেবে ফান্ড এসেছে এদেশে কর্মরত কিংবা বিলাত হতে প্রসবিত নানা সংস্থার হাতে। আর তাতে একদল ধান্দাবাজ মানুষ নতুন করে এখানে খুঁজে পেয়েছে “সুখের ঠিকানা”। 

দরকারী, বেদরকারী, আজগুবি, পরীক্ষামূলক, হাস্যকর নানা হিতেষী প্রোজেক্টে সরকার ও বেসরকার দেদারসে টাকা ঢেলেছেন। আসল কাজ বাদ দিয়ে। অন্তত গার্মেন্টস খাতে ট্রেনীংয়ের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারী ও বেসরকারী ফান্ডের টাকার স্রেফ শ্রাদ্ধ হচ্ছে বললেও কম বলা হবে। এই জনহিতৈষী লাতি ও বিলাতি সংস্থা ও এর উদ্যোক্তা, কনসালটেন্টবৃন্দ যখন সরকারী খাতের দূর্নীতি নিয়ে নানা মাধ্যমে সুকুমার বুলি ঝাড়েন, তখন কি নিজেদের পাজামার বা অন্তর্বাসের বুকপকেটের নিচে গোপনাঙ্গের খুব কাছাকাছি চোরা পকেটে দূর্নীতির যে টাকা রাখেন, সেটার কথা একবারও মনে পড়ে?

কনসালট্যান্সির টু-পাইস:

দূর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় কেনা লেবেনচুষ খেতে সৎ পয়সায় কেনা লেবেনচুষের মতোই মিষ্টি। তবে একটু ভালভাবে খেয়াল করলে দেখবেন দুই নাম্বারি পয়সায় কেনা লেবেনচুষে হালকা একটা চৌর্যবৃত্তির বদগন্ধ আছে। আপনি যদি সেই বদগন্ধ হজম করে লেবেনচুষ খেতে পারেন তবে ইচ্ছামতো দূর্নীতির পয়সার লেবেনচুষ, ললিপপ অবলীলায় খেয়ে যান। আর যদি মনে করেন এই দুই নাম্বারি লেবেনচুষের গন্ধ আপনার গায়েও লেগে যাবে আর আপনার আশপাশের পাবলিক সেই গন্ধ টের পেয়ে আপনাকে একটু কেমন কেমন চোখে দেখবে তবে একটু দ্বিতীয়বার ভেবে নেবেন।

যে পথে আয় করবেন সেপথেই সেটি চলে যাবে। বদ আধুনিকতার পাল্লায় পড়ে অনেকে আজকাল ভাবেন, পুরানো দিনের সেইসব ঠাকুরমার আমলের বস্তাপঁচা নীতিকথা আজকাল আর খাটে না। এখনকার দিনে মেরেকেটে সম্পদ হাসিল না করলে সে বোকা ছাড়া কিছুই না। ভদ্র ও সৎ হলে মানুষ তাকে নিয়ে হাসে। আসলেই কি তাই? পৃথিবী যেহেতু এখনো আদীকালের মতো গোলাকারই আছে আর সূর্যও পূর্বেই ওঠে তাই ঠাকুরমার আমলের নীতিশাস্ত্রও আগের মতোই কার্যকর আছে। বিশ্বাস না হলে নিজেই ট্রাই করুন। দেখুন কী ঘটে?

একলোক জাল টাকা ছাপায়, একবার ভুল করে একটা তিনশ টাকার নোট ছাপিয়ে ফেলছে, চিন্তায় পরে গেছে, নোটটা কিভাবে চালায়??? এক সহজ সরল দোকানদার দেখে বললো ভাই ভাংতি হবে?? দোকানদার টাকাটা ভাংতি করে দিল, লোকটা বাসায় ফিরে ভুবনজয়ী একটা হাসি দিল, বউ জিজ্ঞেস করলো এত খুশি কেন??? বলে নোটটা চালিয়ে দিয়েছি বউ বললো খুব ভাল, লোকটা পকেট থেকে ভাংতি বের করে দেখে,,,, সহজ সরল দোকানদার চারটা পঁচাত্তর টাকার নোট ধরায়া দিছে। চোরের উপর বাটপারি।

 কনসালট্যান্সির ফ্লাশফ্লাড:

রুজি রুটির ধান্দায় ন্যাস্ত ব্যস্ত আমরা সবাই। গতকাল মুরাদ ভাইয়ের কাছে গিয়েছি একটা বিক্রিত পণ্য পৌছে দিতে। তিনি যেহেতু একজন ব্যবসায়ি, তার কাছে জানতে চাইলাম, দ্বিতীয় আয়ের পন্থা হিসেবে কী করতে পারি। তিনি বললেন, আপনি যেটা ভাল পারেন, সেটাই বিক্রি করুন, মানে ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি বিক্রি করা আর কনসালট্যান্ট/ট্রেইনার হিসেবে কাজ করা। তার কথায় পুরোনো একটা শোক উথলে উঠল। একবার একজন প্রতিষ্ঠান মালিকের উদাত্ত আহবানে সাড়া দিয়ে ছুটির দিনের দুপুরে তার কার্যালয়ে গেলাম। তিনি একখানা পাজেরা পাঠিয়ে আমাকে নিয়ে গিয়েছেন।

আমি তো আকাশে উড়ছি, গাঁও গেরামের পোলা, পাজেরোতে চড়লে কার মাথা ঠিক থাকে। আগে হতে তার চাহিদামতো প্রস্তুত একটি পরিকল্পনা ও খসড়া প্রোগ্রাম তাকে দেখলাম। তিনি সেটা দেখে অত্যন্ত উত্তেজিত হলেন…….”আরেহ আরেহ, আপনাকেই তো আমার চাই। এতদিন তো আপনার খোঁজেই ছিলাম। কোথায় ছিলেন বস এতদিন? এতদিন যা করেছি সব ভুল। এতদিন যারাই পরামর্শক হয়ে এসেছ, সব ফ্রড”-ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি তার প্রতিষ্ঠানে একটি আধুনিক HR টীম ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরীতে পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন। তিনি কী চান আর আমাকে কী কী উপঢৌকন দেবেন-তা রফা করলেন।

পরের সপ্তাহ’র ছুটির দিনে প্রথম তার টীম নিয়ে বসলাম। কিছু প্রাথমিক আলাপ/প্রস্তুতি হল। আমি প্রথম প্রেমের মতো করে প্রথম কনসালট্যান্সীতে মনপ্রাণ ঢেলে দিলাম।

পরের সপ্তাহে বসে আছি। পাজেরো  এলো না। সকাল গড়িয়ে বিকেল হল, পাজেরো আসে না। ফোন করলাম ওখানকার এইচআর বসকে। তিনি বহু ঘাঁই কিঁচিং শেষে বললেন, “স্যার, ষাড় একটু বিদেশ গিয়েছেন। যাবার আগে আমাকে বলে গিয়েছেন, আপনার ওই প্রোজেক্টটা নিয়ে তিনি আরেকটু ভাবতে চান। তাই আপাতত আপনার আসার দরকার নেই। উনি আপনাকে শীঘ্রই জানাবেন।” টুট টুট টুট টুট টুট। আমার জীবনের প্রথম কনসালট্যান্সীর ওখানেই গর্ভপাত।

একই রকম গর্ভপাত আমার চেনা গন্ডির মধ্যে অনেক কনসালট্যান্ট ও ট্রেইনারের সাথেই হয়েছে। নাম আর না বলি। এই দেশে ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কনসালট্যান্ট আর ট্রেইনার হিসেবে কতটা ভাত আছে-তা নিয়ে আমার ব্যাপক সন্দেহ আছে। তবে হ্যা, যারা প্রথিতযশা কনসালট্যান্ট বা ট্রেইনার হিসেবে ইতোমধ্যেই নমস্যঃ অবস্থানে আছেন, তাদের কথা বলছি না। আমরা যারা অদূর ভবিষ্যতে প্রথম বা দ্বিতীয় আয়ের পথ হিসেবে ওই দুটিকে বেঁছে নেবার ধান্দায় আছি, তাদের কথা হচ্ছে।

ভাইয়েরা, লাগলে মৌসুমী ফল, স্যানিটারী প্যাড কিংবা মহামারি রোগের ব্যবসা করুন। কনসালট্যান্সী আর ট্রেইনার হবার ইচ্ছা থাকলে মুড়ি আর উস্টা খেতে এখন হতেই অভ্যস্ত হোন।

হ্যা, যদি আপনি ধান্দাবাজ, সেলফীবাজ, আওয়াজবাজ, ফাঁপরবাজ আর চাপড় ও কাপড়বাজ হয়ে থাকেন, তাহলে দুইদিনের একটা “কী করিলে কী হইবে” টাইপ ট্রেইনিং কিংবা PPT Consultancy করে ১০ লাখ টাকা কামাই করা কোনো ব্যাপারই না। আমাকে ফাঁপরবাজ মনে করবেন না। সত্যিকারে ঘটেছে এই ঘটনা। সাক্ষি আছে।

কথার যাদুকরবৃন্দ:

মুখরোচক জারগেন নিয়ে জাগলিং করতে পারা, আর চৌকষ পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দিতে পারাকে যেই দেশে যোগ্যতা ও মেধা হিসেবে স্বীকৃতি তথা পূজা দেয়া হয়, সেখানে আপনার প্রতিভা থাকা একটি পাপ বটে। কী ওয়ার্ডস নিয়ে আমি বরাবরই কাঁচা ও আনাড়ি। কী ওয়ার্ডস শেখার ভয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস তক করিনি। অবশ্য আরো অনেক কারনেই ক্লাস করিনি।

ক্লাস এইট পাশ করার পরে আমার ধারনা, আমি মোট ক্লাসের ১০% ও উপস্থিত হইনি। যাহোক, ওপরে তিনটি কী ওয়ার্ড বা চাল্লু চমক উদাহরন হিসেবে বলেছি। বাংলাদেশে এ্যাডভাইজরী দেয়াটা একটি শিল্প। রাষ্ট্রীয়ভাবেই এ্যাডভাইজরীর পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করা হয়।

যেমন ধরুন, রাষ্ট্র একটি নদীতে ব্রীজ বানাবে। তো, কোন নদীতে, কোন পয়েন্টে, কবে ব্রীজটি বানানো উচিত হবে-সেটা নিয়েও এ্যাডভাইজার হায়ার করা হয়। রাষ্ট্রীয় প্রোজেক্টে বরাদ্দ বাজেটের বিশাল একটি অংশ এ্যাডভাইজাররাই খেয়ে ফেলেন।যাহোক, রাষ্ট্র নিয়ে ভাবনার মতো বড় মানুষ আমি না। আমি আমাকে নিয়ে ভাবি। চারপাশ নিয়ে ভাবি।

জীবন চলার পথে যত মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, তার ভিতরে অনেক অনেক এ্যাডভাইজারও ছিলেন। সব বড় ও বিজ্ঞ মানুষ। তবে কিছু ছিলেন ও আছেন। তেনারা ওই কী ওয়ার্ড নির্ভর এ্যাডভাইজার। যাদের দৌড় হল, প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের তুকতাক, ভুজুং ভাজুং দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ডিল বাগানো। তারপর থেকে মাস ছয়েক বা বছর ধরে নানা স্ট্যাডি, ডেটা কালেকশন, ইনফরমেশন কালেকশন, ক্রিটিক্যাল এনালিসিস, গ্রূপ স্ট্যাডি, ইমপ্যাক্ট এনালিসিস-হাজারটা প্রোগ্রাম শেষ করে, থোড়বড়িখাড়া করে, পুরো সিস্টেমে আউলা লাগিয়ে তারপর আবার নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানে নতুন করে স্ট্যাডি, ডেটা……………..>ইনফরমেশন>ক্রিটিক্যাল এনালিসিস>গ্রূপ স্ট্যাডি নিয়ে পড়া।

আমরা যারা সারাবছর মাঠে থাকি, জল কাদা ভেঙে প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করি, তারা চেয়ে চেয়ে ওনাদের শনৈ শনৈ উন্নতি, আধিপত্য দেখি। তেনারা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে দামী গাড়িটাতে আসেন, যান। নতুন এসি বসানো রুমটাতে এসে ঠান্ডা হন, তেনারা এলে পিয়ন চাপরাশীদের মধ্যে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। আমরা পাতি ম্যানেজাররা খাতাপত্র বগলে নিয়ে দৌড়াতে থাকি। তেনারা এলে চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে যাই।

সারাদিন হাজারটা কাজ থাকলেও, সেটা বন্ধ রেখে ওনাদের কাছ থেকে এ্যাডভাইস পাবার অপেক্ষায় বসে থাকি। কখন, কোন শুভক্ষণে তেনার মাথায় একটা আইডিয়া আসবে, আর আমি সেটা মিস করে কোম্পানীর সমূহ ক্ষতি করে বসি-এই ভয়ে। কেন আমরা অমন পারি না-সেই বকা খাই। কারন একটাই-ওই যে, কী ওয়ার্ডসগুলো পারি না। মুখস্ত কিছু চানক্য বাক্য আর ঝা চকচকে কোট পড়ে পাওয়ার পয়েন্ট এ্যাডভাইজরি জানিনা।হায়রে কী ওয়ার্ডস! হায়রে ফোকাস গ্রূপ স্ট্যাডি! [কারো কাছে যদি আরো কী ওয়ার্ডসের সংগ্রহ থাকে, জানিয়ে উপকৃত করবেন। আর হ্যা, পাগলামোপূর্ন এমন লেখালেখি দেখে আমার সুহৃদদের কষ্ট না পেতে অনুরোধ করব। জগতে কোনোকিছুই অবিমিশ্র নয়। যেমন, গোলাপে কাঁটা থাকে। তাই আমি শুধুমাত্র সুবচনেই থাকব, সেটা আশা করা ভুল হবে। আর ভদ্রতা বজায় রেখে যদি কাউকে গালাগাল করতে চাই, এমন স্যাটায়ার লেখা ছাড়া উপায় কী? ভাল কথা, সবাই এক না-এই কথা বলতে বলতে এশ্যাদ চাচা মরে গ্যাছে। আমার মরার কোনো সখ নাই। এই কথা বলতে বলতে আমার মুখের দাঁতও ৩২ টা হতে ২৯ টা হয়ে গেছে। আপনি যদি এই লেখা পড়ে অফেনডেড হন, তাহলে আমি এটা আপনাকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছি। আর যদি পড়ে ফোৎ করে শব্দ করে ভুলে যান, তাহলে আমি এটা আমাকে লিখেছি।]


এসব দেখি, ‘সাপ’এর হাঁটবাজার:

বাংলাদেশ উন্নত দেশে উত্তরিত হওয়ায়, যেসব লাভ-ক্ষতি সংঘটিত হয়েছে, তার একটি তালিকা করেছিলাম একবার। এই লেখাটি তারই একটি ’টেইল স্টোরী’র মতো।
একটি দেশে সামরিক শাসন জারি হয়েছে নাকি হয়নি, তার লক্ষণ বা নিদর্শন নাকি দুটো-১. সব পুকুর ডোবা হতে কচুরিপানা নিষ্কাশনের একটা মচ্ছব চলছে কিনা। ২. দেশের সব নারকেল সুপারি গাছের গোড়ায় সাদা চুন লাল পাড় দেবার মচ্ছব চলছে কিনা-তা খেয়াল করুন।

কর্পোরাল হতে এবার কর্পোরেট।

একটি অফিসে বা তার কোনো বিভাগে নতুন বস এসেছে তা কীভাবে বুঝবেন?

সহজ, যখন দেখবেন, সেই টিমের এমনকি ১০ বছর ধরে কাজ করা লোকটাও তার JD টাইপ করতে ব্যস্ত। আর ২০ বছর ধরে কাজ করা লোকটা তার JD কী-সেটা জানার জন্য অন্যদের পেছন পেছন দৌড়ে ক্লান্ত।
এবার, সবার প্রিয় এইষাড়।

বলুন তো, কোনো অফিসে নতুন হেডপেইচার এসেছেন-সেটা কীভাবে কী লক্ষণ দেখে বুঝবেন?

সহজ। যদি দেখেন হঠাৎ করে সব পায়খানার সামনে HIS & HERS নেমপ্লেট বসানো হচ্ছে, কিংবা, অফিসের পিওনদের ইউনিফরম পরিহিত দেখা যাচ্ছে, তাহলেই বিলক্ষণ নতুন হেডপেইষাঁড় নাজিল হয়ে থাকবেন।

ভাইয়েরা, ভেলকিবাজি বেচে আর কত দিন?

দেশের চলমান ব্যাখ্যাতীত কসমেটিক ডেভেলপমেন্ট আসার পরে দেশটাতে নেগেটিভ বা পজিটিভ যা-ই বলি, একটি বিরাট সংখ্যক চাটার দল তৈরী হয়েছে, যারা সব চেটেপুটে খাঁক করে দিচ্ছে। ইয়াজুজ মাজুজ নামে কেতাবে যে প্রাণীর বর্ণনা ছিল, এই চাটারা তার দশগুন বেশি শক্তিতে সব চেটে ও শুষে নিয়ে নিচ্ছে। চাটার শক্তিতে পেছানো বা চাটতে অক্ষম বাকিদের জন্য বেঁচে থাকাটাকেই এরা করে তুলেছে একটা বিরাট বিরম্বনা।

চাটুক। আরও চাটুক। আজকে তাদের নিয়ে কথা নয়। আজকে কথা বলব উন্নয়নের উপজাত ও সুবিধাখোর একটি জাত নিয়ে।

যাদের নিয়ে কিসসা, তাদের নিক নেম হল ‘সাপ’ (সাহেবের নয়া রূপ)। পুরো রূপটা বলছি না, *টাল নিরাপত্তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে। অবশ্য এই লেখা পড়ে ’সাপ’ ছ্যাড়দের মন খারাপ বা আমাকে শাপশাপান্ত করার কিছু নেই। কারণ ওই সাপদের মধ্যে আমিও একজন স্বগ্রোত্রীয় ’সাপ’। তাই এক অর্থে আমি নিজেকে নিজেই পাঁকে নামিয়ে পাঁকাপাঁকিভাবে পাঁকাহত করছি। এখন আমি যদি নিজেকে নিজেই মলেস্ট করি, কার কী বলার থাকতে পারে? তাই না?

যা বলছিলাম, উন্নত দেশে রূপ নেবার পরে, অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠে (জলিল ভাইয়ের ভাষায়-“We become so proud, that, our chest become breast”) আমাদের ‘উন্নত’ করে তোলার পরে দেশে (আমার মতো) এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী গোত্রের জন্ম হয়েছে, যার একটি শিল্পিত প্রকাশ হল ‘…M সাপ’। …M সাপের এব্রেভিয়েশন জানতে একটু পেছনে নজর করি।

অনেক আগে, আমি তখন মাত্রই ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ শুরু করেছি। তো, একজন মধ্যবয়সী ও মধ্যম শ্রেনীর পেশাজীবি সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, আপনার ডেজিগনেশন কী?”
[তিনি যেই উত্তরটি সেদিন দিয়েছিলেন, আমি সেটি হুবহু তুলে ধরতে ও পাঠককে সত্যিকারের ভাইবটি বোঝানোর স্বার্থে এডিট না করেই বলছি।]

তিনি উত্তর দিলেন, ”ভাই, আমার ডেজিগনেশন হল-AM। আপনি AM বোঝেন তো? এইশটেনট মাদার…*দ।”-তার তীব্র উত্তর। [আবারও দুঃখ প্রকাশ করছি]

আমি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম ওনার কথা শুনে। এভাবে কি কেউ নিজেকে পরিচীত করতে পারে? [AM = Assistant Manager]

কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে, নিজেকে নিয়ে ওনার এই তীব্র শ্লেষের বিস্তারিত ব্যখ্যা ওইদিন আমি তার কাছে থেকে শুনে নতমস্তক হয়ে চলে আসি। সেই গল্প অন্য কখনো করব। তো, ওনার সেই এব্রেভিয়েশনকে যদি নর্মস মানি, তাহলে আমার পজিশনের এব্রেভিয়েশন স্তরে স্তরে বেড়ে হবে-M-মানে ’নারেল মাদার…দ’। [ভাষাশৈলী অগ্রহনযোগ্য-দুঃখিত।] আমার কেতাবী র‌্যাংক ’নারেল মাদার…*দ’ হলেও আমাকে ’ছ্যাড়’ সম্বোধন কাম্য নয়। তবে ‘ভাই……আঁ’ও (তিন আলিফ টান) কাম্য নয়। ‘ভাই’ ইজ এনাফ।

তো, আমার স্ব-গোত্রীয় এই সুবিধাভোগী ‘সাপ’ শ্রেনী, যারা প্রায় সবাই-ই উঠে এসেছি গ্রাম হতে, যারা ‘মেটটিক’ পাশ করার আগে জানতামও না, ‘ঢাকা’ নামে একটা শহর আছে যেটা আদতে ঢাকা নয়, বরিশালের ভাষায় ‘উদলা’, যারা শৈশবে স্বপ্নদোষেও কখনো ভাবি নি, যে, আমরা নিজেদের গন্ডগ্রামের বাইরে কখনো পা রাখতে পারব। বাপ-দাদা’র আদি পেশা হতে বেশি কিছু করব-সেটাতো মনেও স্থায় পায়নি।

এক্ষণে একখানা টেস্টিমনি দিয়ে যাই। প্রত্যেক বস্তুরই ট্রেডঅফ বলে একখানা প্রতিক্রিয়া থাকে। ছোটবেলায় মা’কে বা বাবা’কে হারিয়ে সংগ্রাম করে বড় হয়ে ওঠা আমাদের কাঝে ইন জেনারেল গৌরবের, আমরা তা নিয়ে রগঢ় করি, তাকে গ্লোরিফাই করি। কিন্তু, এটাও সত্যি, মা বা বাবা ছাড়া বড় হওয়া মানুষ বড় হয়েও নানা রকম পারসোনালিটি ডিসঅরডারে ভুগে থাকেন। ওটাকে স্কিপ করা যায় না। নিজ নিজ সংগ্রামী জীবনের কাহিনী তো আমরা সবাইই করি। খেটে, সংগ্রাম করে, নানা প্রতিকূলতার সাথে যুঁঝে সমাজে মাথা উঁচু করে দাড়াবার গল্প আমরা রসিয়ে রসিয়ে সমাজকে শোনাতে গর্ব করি। কিন্তু, এটাও সত্যি, যতই গ্লোরিফাই করি, সংগ্রামী সত্বার এই গ্লোরির পেছনে একটা কালো সত্যও থাকে। থাকে সংশয়িত একট ট্রেড অফ, সেটা হল-

একদার ভূমিপুত্র অথবা ঘেঁটুপুত্র যদি একদিন রাজপুত্রের আসন পেয়ে যান;
এর ইতিবাচক দিক কী?
এর নেতিবাচক দিক কী?

মনে রাখতে হবে, একদার ঘূঁটেকুড়ুনির পুত্র কিংবা ভূমিপুত্র’র রাজপুত্রের আসনে আসীন হওয়াকে একদল মানুষ নিরঙ্কূশভাবে গেীরাবান্বিত করে থাকেন। গোবরে পদ্মফুল প্রবাদটি এই ন্যারেটিভকে এনকারেজ করেই উদ্ভূত। আবার, আরেকদল আছেন, যারা Cult Classic তত্বে বিশ্বাসী। তারা মনে করেন, ‘ছোটলোকের’ বেটাদের রাজাসনে বসার স্বপ্ন দেখাই পাপ। কূঁজোর আবার চিৎ হয়ে শোয়ার সখ-শ্লেষটির জন্ম এই ধারনাকে ভর করেই।

ধরুন, এক্সট্রিম কেসে, আপনার ড্রাইভার। সে যদি একদিন আপনার কোম্পানীর পেইড সি.ই.ও নিযুক্ত হয়, এর সার্বিক ফলাফল কতটা ইতিবাচক ও কতটা নেতিবাচক হতে পারে? কোন কোন দিক দিয়ে? ভাবতে থাকুন, বলতে থাকুন।

প্রগতিশীল ও উদারনৈতিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসীরা ’জন্ম হউক যথা তথা, কর্ম হউক ভাল’-নীতিকে সামনে এনে বলে থাকেন, মানুষ যেমন উৎস হতেই পৃথিবীতে এসে থাকুক, তার পরিবার বা পরম্পরা যেমনই হোক, নিজের মেধা, যোগ্যতা, কাজ, কথা ও ইচ্ছার স্ফূরণ ঘটিয়ে তিনি যেকোনো সময়ে, স্থানে ও পরিস্থিতিতে শাইন ও ফ্লারিশ করতে পারেন। এবং, তার উৎসমূল তার চরিত্র, বিশ্বাস, চিন্তা বা দর্শনে প্রভাব ফেলে না। তিনি সেটাকে নিজের এফোর্ট দিয়ে জয় করে নিতে পারেন।

আবার গোঁড়া ও কট্টরপন্থীরা বিশ্বাস করেন, যে, মানুষ যে অবস্থানেই পৌছাক না কেন, তার জন্ম, পরিবার, জেনেটিক পরম্পরা, ক্লাস অরিজিন-এসব তার আজীবনের চিন্তা, আচরন, দর্শন-এসবকে প্রগাঢ়রূপে প্রভাবিত করে। এর একটা ছাপ তার সবকিছুতেই থাকবে আজীবন। দামী রেস্তোরাঁতে যতই ফর্ক আর স্পুন দিয়ে খাক না কেন-একটা অতীত দৈন্যের হালকা আবহ তার সার্বিক অবয়বে থাকবেই। কঙ্কনদাসী যতই কাজল রেখা সাজুক, তার নিত্য জীবনে কঙ্কনদাসীর চরিত্র লুকোনো অতি কঠিন হবে। যাহোক-সত্যাসত্য বিচার দূরহ। আপনাদের কী মনে হয়-মানুষ তার শেকড়ের খাসলত জয় করতে পারে? বা, আদৌ কি জন্মদাগ বলে কিছু থাকে? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। তা হল, জেনেটিক্যালী এবং পরিবারের বংশলতিকার ধারা হতে মানুষ আদৌ কি কোনো লিগ্যাছি ক্যারি করে? মানুষ কি পুরোটাই নিজেকে নিজে গড়ে? পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাতে কিছুটা পালক যুক্ত করে? নাকি মানুষ যা, তার একটা বড় অংশই তার শেকড় হতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়?

ঢাকা শহরে একদিন গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরব, গাড়ি হতে নামলে ব্যাগটা বহন করার জন্য দরোজা খুলে দাড়িয়ে থাকবে একজন সান্ত্রী, সভাসমিতিতে আমাদেরকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাওয়া হবে, আমরা অলংকৃত করব বিশেষ আসনগুলো-এই কথা তো দুঃস্বপ্নেও কোনোদিন মনে স্থান পায়নি শৈশবে। আর আজ?

সমস্যাটা হয়েছে সেই স্বপ্নাতীত প্রাপ্তির বদহজমে। বদহজমের স্বরূপটা বলি।

একটি প্রচন্ড ব্যস্ত অফিস দিনের বিকেলে ফেরার সময়ে ফার্মগেট, গুলিস্তান অথবা মতিঝিলে অভাবনীয় ও অবিশ্বাস্যভাবে যদি দেখেন, হঠাৎ একটি ডবল ডেকার বাস পথের মধ্যেই কোনো কারনে সব যাত্রী নামিয়ে ফিরতি ট্রিপ ধরতে লোক ডাকা শুরু করে “ওই ছ্যাড়া ব্যাড়া, কাজিআড়া, মিপপুঁ মিপপুঁ মিপপুঁ”, তখন হঠাৎ দেখবেন, যাত্রীসাধারন, যারা এতক্ষণ একটি বাসে কোনোমতে সামান্য চিপায় উঠতে পারলেও বর্তে যেতেন, তারা বাসে উঠে যাস্ট উন্মাদ হয়ে যান।

কোথায় বসবেন, নিচে, না দোতলায়, একবার সামনে বসে, তো একটু পরে পেছনে, আবার মাঝখানে, বামপাশে ডবল সিটারে বসে, তো আরেকবার ট্রিপল সিটারে। হঠাৎ করে স্বপ্নেরও অতীত কিছু পেয়ে গেলে যা হয়। সেই একই কান্ড ঘটেছে আমাদের জীবনে।

স্বপ্নেরও অতীত প্রাপ্তি ঘটায় আমরা আত্মহারা হয়ে জন্ম দিয়েছি এক ইতিহাসের। জন্ম দেবার আগে অবশ্য কায়দা করে ভুলে গিয়েছি বা ভুলে থাকা শিখেছি নিজেদের গোপন অতীত। ভুলে গিয়েছি ’এসিসটেন’ হিসেবে শুরু করা আমাদের ক্যারিয়ারের ’হিশটোরী’ আর তখনকার বসদের নোংরামো ফেস করে মনে মনে করা শপথ, “যেদিন আমি বস হব, সেদিন আমার সব টীমমেটের বন্ধু হব আমি।” বাংলা সিনেমার নায়কের শপথের মতো।জাতে ওঠা জাত সাপদের, মানে আমাদের নিজেদের কোনো কাজ থাকে না, থাকলেও করতে হয় না, আমাদের কোনো লক্ষ্য নেই, বার্ষিক কোনো টার্গেট নেই, দৈনিক কোনো রুটীন নেই, চোথা সাইন করা ছাড়া কোনো পরিকল্পনা নেই, টীম বানানো বা তাদের উন্নত করার কোনো দায়ও নেই।

সবচেয়ে বড় ভয়ানক হল, নিজেদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়ানোরও কোনো চাপ নেই। বছর বছর দাপট আর নোটের সংখ্যা বাড়লেই আমরা খুশি। কর্মদিবস ও মাসের অর্ধেকই যায় মিটিঙে চেয়ার অলংকরন আর দুই দশটা সেমিনার/পিকনিকের লীভ টুগেদারে (গেট টুগেদার)। ঠান্ডা রুমের দরোজায় স্টিকার সাঁটা। নরম গদির চেয়ার। বসলেই ঘুম এসে যায়। তাও যদি ঘুম না আসে, চোখের শান্তি দেবার জন্য দুই চারটা হুর-হুরেইন তো আছেই। দৃশ্যমান কোনো ভ্যাজাল না দেখলে আর বায়ারের রেড মার্ক না পেলে নিয়োগকর্তাও ‘সেটিশফাইড’।

তারপরও না পোষালে পেশাজীবি গোত্রকে ম্যানেজ করে সিন্ডিকেটকে খুশি করে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানকে আশির্বাদধন্য করতে নেমে পড়া।আবার, আমাদেরই গরমে, দাপটে, বিলাসে, অত্যাচারে, হম্বিতম্বি আর শো-অফে বাদবাকিরা রীতিমতো তটস্থ ও প্রাণ ওষ্ঠাগত।

ধরাকে সরা জ্ঞান করে আকাশে উড়তে থাকা আমার মতো এই সাপদের অত্যাচারে এদের জুনিয়ররা, টীমমেটরা জেরবার। অত্যাচারিতদের ফেসবুক ও লিংকডইনসহ ইনবক্সের ঘৃনার উদগীরন ও গালাগালি দেখতে পেলে এই সাপরা মরমে না মরলেও গরমে মরে যেতেন।

উন্নয়নের উপজাত হলাম আমরা সাপরা। উন্নয়নের একচেটিয়া সুবিধাভোগীও আমরা সাপরা। [আমার স্ব-জাতি ছ্যাড়রা আমার ওপর নাখোশ হয়ে অভিশাপ বর্ষণ করবেন কিনা জানি না। অবশ্য এমনিতেও অভিশাপের অন্ত নেই। বড় ছ্যাড়রা পেলে আমাকে গণধোলাই দেবেন-তা নিশ্চিত।

আর যারা মনে করেন, এত সুন্দর সুন্দর বিপ্লবী লেখা যিনি লেখেন, তার টীমে কাজ করলে তো মনে হয় সগ্গ আর সগ্গ। দুঃখিত। ব্যক্তি আমি ও কর্পোরেট আমি দুই জন আলাদা মানুষ। আর কর্পোরেটের যাবতীয় কিছুর ভাগ্য নিয়ত্তা আমরা একারা নই। সুতরাং, বিজ্ঞাপন দেখে মাল কিনে পরে আহাজারি করবেন না।

কখনো কেবলমাত্র কোনো পীরসাপকে দেখে তার প্রতিষ্ঠানে জয়েন করবেন না। আমরা অনেকেই নিজ নিজ মেনটর, পীর, সহমত ভাইদের অধীনে বা ‘বসশিপে’ চাকরি করবার খাহেশ পোষণ করি। খোলাখুলিভাবে সেটি অনেকে বলিও।

কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করে আপনার যত ঠাট-বাট, ভাব-সাব, কাটিম, হ্যাডোম অর্জিত হয়েছে ও হবে, আপনি ভাই হতে ’সাপ’ (সাহেব) হয়েছেন যেটার গরমে আপনি ফুলে কোলবালিশ হয়ে আছেন, পা দু’খানাকে কিঞ্চিৎ মাটি হতে ওপরে মনে করছেন। মনে রাখবেন, ওই হ্যাডোম ও ভাব বড্ড সাময়িক। ওই হ্যাডোম আপনাকে কোম্পানী তার প্রয়োজনেই করে দিয়েছেন। মই কেড়ে নিতে সময় লাগবে না। আপনারও পায়ের নিচের মাটি সরতে সময় লাগবে না।

একজন প্রফেশনাল হিসেবে আপনি যত ওপরের পজিশনে যাবেন, মানুষের তত বেশি কাছাকাছি যেতে হবে। তত বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে নিজেকে Accessible করে তুলতে হবে। মানুষের কাছে নিজেকে তত বেশি easy available রাখতে হবে। আপনার স্বার্থেই। আপনি জনবিচ্ছিন্ন থাকলে আপনার মিশনই ভেস্তে যাবে। যত ওপরে যাবেন, যত বড় হবেন, ততই শেকড়ের সাথে যোগ কমবে, সত্য জানার, তথ্য জানার, প্রান্তের কথা প্রান্তজনের কথা জানার সুযোগ আপনার কমতে থাকবে। প্রান্তের রিদম জানার ও অনুভূতি জানার ও উপলব্ধি করবার ক্ষমতা কমতে থাকবে। প্রান্তিকের সাথে, শেকড়ের সাথে এই দূরত্বই আবার আপনাকে একদিন ধ্বসিয়ে দিয়ে মাটিতে ফেলবে। তাই ওপরে ওঠার সময়ে, চূড়ায় যাবার সময়ে কীভাবে মাটির সাথে যোগসূত্র বজায় রেখে চলবে-সেটা শিখতে শিখতে এগোতে হয়।

বাঙাল মূলকে হয় উল্টো। যত উপরে ওঠা হয়, মানুষের কাছ হতে তত দূরত্ব তৈরী করি আমরা। তত অধরা করে ফেলি নিজেকে। যেন অনেকটা, আমি গদীতে আসীন দেওয়ানবাগী হযরত। যেখানে সবাই আমার দরবারে এসে কাচুমুচু করবে। হাত কচলাবে। করুনা ভিক্ষা দেব আমি। আমার দুই মিনিট সময় পেতে মানুষ আটাশবার ইনবক্সে নক করবে। আমি Seen করব, reply করব না। যেন আমি ভগবান বিষ্ণু।

আমরা ভুলে যাই, যে, মাটির পৃথিবীতে মাটির সব মানুষই দিন শেষে CB আবদুল্লা।
মাটির কাছে থাকুন। মানুষ মাটির তৈরী। মানুষের কাছে থাকলে মাটির কাছেই থাকা হবে।

একজন এইচ.আর প্রফেশনাল যদি নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটির ডাইভারসিফাইড পিপলদের সাথে নিবিড়ভাবে কথা বলবার অভ্যাস গড়ে না তোলেন, তার মিশন বাধাগ্রস্থ হতে বাধ্য। তার কাজ ভুল ডিরেকশনে যেতে, ভুল ফলাফল দিতে বাধ্য। মানুষের সাথে কথা বলার মতো কার্যকর শিক্ষাপদ্ধতি খুব কমই আছে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি ক্লাসরুম লারনিংয়ে খুবই দুর্বল। বেধায় আমাকে শিখবার জন্য অন্য পথ অবলম্বন করতে হয়। আমার নিজস্ব পন্থার মধ্যে রয়েছে লিসেনিং টু পিপল, অবজারভেশন, অগ্যস্ত হাঁটা এবং গোগ্রাসে সব পড়া। এই চার পথে আমি একদমই চুজি না। যা যখন সামনে আসে, সেটাই গিলি।

এই পন্থা আমাকে শিখতে সাহায্য করে। আমি মনে করি, অন্যান্য পন্থার পাশাপাশি এই চারটা পথ আমার অন্য এইচ.আর সহকর্মীরাও অবলম্বন করে দেখতে পারেন। হয়তো করেনও।

এই গতকালই প্রতিশ্রুতি মতো ৩ জন (আপাত) ব্যর্থ উদ্যোক্তার গল্প শুনলাম। ফোন করে। প্রত্যেকের সাথে ২০-২৫ মিনিট। আমি যা শিখেছি, তা অমূল্য।

এইচ.আর প্রফেশনাল যদি গণমানুষের কাছে অধরা থাকেন, বা থাকতে পছন্দ করেন, তার নাগা সন্নাসী হওয়ার ব্রত নেয়া বরং ভাল ছিল বলব।

গাইজ, ইউ আর পিপল ম্যানেজার। পিপলের মাঝেই আপনার নির্বান।
বি.দ্র. যদি আপনি এইচ.আর প্রফেশনাল হন আর মানুষের কাছে অধরা একজন আইডলের নামান্তর হয়ে থাকেন, তাহলে আমার এসব হাবিজাবি গায়ে মাখবেন না। এসব কথা আপনাকে বলা না। আপনার নিজস্ব চয়েজকে আমি সম্মান করি।

গরমটা একটু কমান। ’সাপ’ হতে না চেয়ে ’ভাই’ হোন। কর্পোরেট হতে পাওয়া ঠাট-বাট নিয়ে অহঙ্কারে ফুলে কোলবালিশ হওয়াটাতো ঠিকই বাগিয়েছেন তবে নিজের ছোটলোকির ল্যাঞ্জাটি লুকাতে পারার বিদ্যাটা রপ্ত করতে পারেননি। সময় সময় ঠিকই বেরিয়ে পড়ে। আপনার সত্যিকারের স্থানটা একটু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই?

দেশে তখন বৃটিশ শাসনের শেষদিক। কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরু কংগ্রেসের সাথে বড় লাটের যেকোনো ইস্যুতে মিটিঙে যেতেন। তো একসময় কংগ্রেসের অন্য নেতারা একটু জেলাস হতে লাগলেন যে কেন জওহরলাল একা এত ফোকাস পাবেন, কেন তিনিই সব মাতবরি করবেন? তো একবার কংগ্রেসের কোনো এক বড় অনুষ্ঠানে বড় লাট মানে বৃটিষ গভর্নর জেনারেলকে দাওয়াত করা হবে।

ওই ইর্ষাকাতর নেতারা সম্মিলিতভাবে জওহরলালকে গিয়ে ধরলেন, ”আপনি এত কষ্ট করেন, প্রতিবার আপনাকেই দায়ীত্ব নিতে হয়। এবার আপনি একটু রেষ্ট নিন। আমরা যাব বড় লাটকে দাওয়াত করতে।” জওহরলাল রাজি হলেন।

ওই নেতারা একদিন গিয়ে হাজির বড় লাটের অফিসে। তিনি জানতে চাইলেন তারা কেন এসেছেন। তখন নেতাদের পান্ডা গোছের একজন বললেন, “We shall eat you.” বড় লাট তো ভয় পেয়ে গেছেন। কী বলে এরা? তাকে খেয়ে ফেলবে?

বড় লাটের কিংকর্তব্যবিমূঢ় চেহারা দেখে নেতারা ভাবল বড় লাটকে একা দাওয়াত করায় হয়তো তিনি অখুশি। সাথে সাথে তারা বলল, ”We shall eat you with your wife.” বড় লাট অজ্ঞান। তো, যেমন ভাবই ধরেন না কেন, আপনারা ওই নেতাদের মতোই।

You will eat the Governor with his wife.

ইন জেনারেল, মেনটর বা পীর-দরবেশকে দেখে চাকরি নিতে আমি সবসময় অনুৎসাহিত করি। অভিজ্ঞতা বেশিরভাগই নেগেটিভ। তবে, এই মেনটর বা পীরভাইয়ের টিমে কাজ করতে চাওয়ার ব্যপারটার কিছু পজিটিভ দিক আছে। সেই দিকটি নিয়ে আমার ভাবনাটি বলব।

একজন মেনটর বা আইকনের সরাসরি অধীনে কাজ করতে পারলে ইনফরমাল, নন-ইনসটিটিউশনাল, আন-অফিশিয়াল, নন-কনভেনশনাল এবং হ্যা, ফরমাল লারনিংয়ের প্রচুর সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকে। সেই লারনিংয়ে ফটোকপি করতে পারা, মেইল লিখতে পারা যেমন আছে, যেগুলো খুব প্রনিধানযোগ্য নয়। মূল লারনিংটি হল ওই বস বা মেনটরের নিকট হতে চিন্তা করতে শেখা, ভাবতে শেখা, যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করতে শেখা, জীবন ও জগত সম্পর্কে বোধ অর্জন করা, তার অভিজ্ঞতাগুলো জানা ও সেগুলো হতে নিজের ডিসকোর্স ঠিক করতে পারা, স্ট্রেস নিতে পারার শিক্ষা, ডিসিশন মেকিং সক্ষমতা অর্জন। এগুলোর ভিতরে আমার কাছে সবচেয়ে দামী মনে হয় চিন্তা করতে শেখার ক্ষমতা অর্জনটি।

একজন এ্যডমিনিসট্রেটর, মেনটর, কোচ, বস, লিডারের সবথেকে মূল্যবান দিক হল তার থট প্রসেস। হাউ টু থিংক। কীভাবে যৌক্তিক ও বিধিবদ্ধভাবে চিন্তা করতে হয়, কীভাবে স্তরে স্তরে মেথডিক্যালি ভাবতে হয়, সেটি শেখা যায় মেনটরের অধীনে থাকলে। এটাই মানুষে মানুষে পার্থক্য গড়ে দেয়। সিনিয়র, মেনটর ও বসের কাছ থেকে জুনিয়র ও সাবোর্ডিনেটরা কী শিখতে পারেন, বা, কী কী শেখার কথা?

সবার আগে আমাদের মনে যেটা আসবে, সেটা হল, দক্ষতা। হ্যা, বিভিন্ন কাজ করবার দক্ষতা শিখে নেবার জন্য একটি বড় জিনিস। তবে আমি বলব, সেটি বরং তুলনামূলক অফিসার পর্যায়ের সিনিয়র সহকর্মীদের হতে শেখার বিষয় হিসেবে বেশি মানায়। কিন্তু, আপনার সাথে যদি একজন খুব সিনিয়র কর্মী থাকেন, ধরুন GM/Director, তার হতে আপনার টেক এ্যওয়ে কী কী হওয়া উচিত?

  1. How to make decision. 2. How to handle situation. 3. How to plan team drives. 4. How to design a departmental plan. 5. Problem solving. 6. Thinking process. 7. DEIB 8. Judgement 9. Diversified philosophy 10. Structural framework.

জানেন কিনা, আমরা অনেক অনেক কিছু হয়তো পারি না। তবে তার ভিতরে সবচেয়ে মারাত্মক অক্ষমতাটি হল আমরা যৌক্তিক ও যথাযথ তরিকায় ভাবতে বা চিন্তা করতে অক্ষম।হয়তো আপনার খটকা লাগবে, আরেহ, ভাবনা চিন্তা করা আবার এমন কি রকেট সায়েন্স। তবে, একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন, গভীরভাবে কোনো কিছু নিয়ে ধাপে ধাপে চিন্তার ধারা সাজাতে পারা সহজ কাজ নয়। বিশেষত, যখন ক্রাইসিস আসে, যখন স্ট্রেস বা হেকটিক সিচুয়েশনে পড়ে যাই, তখনও ঠিক যেটি ভাবা দরকার, যেভাবে ভাবা দরকার, যেরকম করে ভাবলে মুশকীল আসান হবে, সেটি সেভাবে ভাববার অভ্যাস ও সক্ষমতা অর্জন খুব বড় বিষয়।

একজন পীর বা সহমত ভাই, যদি তিনি উপযুক্ত হয়ে থাকেন, তার বসশিপে কাজ করলে এই দিকটি রপ্ত করবার ভাল সুযোগ থাকে। ওই থট প্রসেসটা শেখার জন্য, র‌্যাশনাল থিংকিং শিখতে, জাজমেন্ট শিখতে একসাথে কাজ করতে পারা এক নেয়ামত।]


বড়দের নিয়ে ছোট কিছু কথা:

এক.

এই অংশটি অত্যন্ত বায়াজড, প্রিজুডিসড এবং ভিনডিকটিভ। অনেকের চিন্তার সাথে কনট্রাডিকট করতে পারে। তাই এভয়েড করুন।
’ছোট’বেলা হতেই আমার ‘বড়’ মানুষদের প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা কাজ করত। ‘বড়’ মানে বয়সে, ধনে, মানে, স্টাটাসে, মেধায়, ক্লাসে-সবভাবে। একে আপনি জাতিবিদ্বেষও বলতে পারেন, হিংসাও, ইনফেরিয়রিটি সিনড্রমও।
সে কারনে, আমার জগতটাকে সবসময়ই ‘ছোট’দের নিয়ে গড়েছি।
ছোটলোকদের সাথে চলাচল, উঠবস, খানাপিনা, মোয়ামালাত, লেনদেন, দহরম মহরম। অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য, জুনিয়র, অবহেলিত, ইনট্রোভার্ট, আনএক্সপোজড, লো টি.আর.পিদের সাথে আমার খায়খাতির।
’বড়’দের কাছে কম ঘেঁষি, কম বসি। ‘বড়’ নায়ে নদী পার হই না। ডিঙ্গিই সই।
এত অবশ্য ক্যারিয়ারের ক্ষতি বই লাভ হয়নি। বস্তুত বড় কিছু পেতে হলে ’বড়’দের খয়ের খাঁ না হয়ে উপায় নাই।
বড় পদ, বড় চাকরি, বড় দাও, বড় খেলাত, বড় পদবি, বড় বিজনেস, টি.আর.পি পেতে বড়রাই মাস্তান। তাদের ট্যাকশো না দেয়ায় ওগুলোর কাঙাল আমি।
তবু মেনে নিয়েছি। তাই টাইটানিক ও আইকনিকদের হতে দূরে থেকে কুলী, মজুর ও ‘জুনিয়র’ ক্যাটেগরীকে নিয়ে চলতে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
কিন্তু, কখনো কখনো তো নমো শুদ্রকে বাহ্মনের দরোজায় করাঘাত করতেই হয়। যেমন ধরুন, পূজা এলো বা পোলার পৈতে। তখন তো কিছু করার নেই। পূজা, এবাদত, পৈতে বা মিলাদ কিংবা শাস্ত্রজ্ঞান-এগুলো তো ওইসব ’বড়’ ‘বড়’ কুলীনদের দখলে। তাই তখন বাধ্য হয়ে ‘বড়’ ‘বড়’ হাস্তিদের দরোজায় কিঞ্চিত বিরক্ত করতে করাঘাত করি।
আজও করেছিলাম জনৈক ‘বড়’কে। খুব ভদ্র, নম্র, জড়সড় ও বিনয়ের সাথে হাত কচলে তাকে একটা ছোট্ট শাস্ত্রজ্ঞান সম্পর্কে মতামত দিতে অনুরোধ করেছিলাম।
’বড়’ সাহেব আমাকে চেনেন। তিনি আমার বদনপুস্তক বন্ধু, আগেও আলাপসালাপ হালকা হয়েছে। তাছাড়া, বাজারে আমার যে পরিমাণ দুর্নাম, তাতে একই বাজারের বাজারি হিসেবে আমাকে না চেনার সুযোগ কম। তারও পরে, অনেক আগে কোনো এক অনুষ্ঠানে নিজে হতে এগিয়ে এসে আমার হাত টেনে নিয়ে কচলে দিয়েছিলেন-এই স্মৃতি মনে ছিল বিধায়, সেইটার ওপর ভরসা করে এপ্রোচ করেছিলাম। তার মোট সময় খরচ হত ৩০ সেকেন্ড।
’বড়’ কত্তা আজ চিনলেন না। মনেও করতে পারলেন না। সেটাও আফসোস না। (আমিও মানুষকে ভুলে যাই। আমার ফেস আইডেন্টিফিকেশন মেমোরি অত্যন্ত দুর্বল।) পরিচয় মনে করাবার চেষ্টা করলাম, তিনি এতটুকুতেই ‘ঘ্যোৎ’ জাতীয় একটা শব্দ করলেন। অতঃপর অত্যন্ত রূঢ় ও অভব্য ম্যানারে বিনা দক্ষিণায় শাস্ত্রজ্ঞান দিতে অস্বীকার করলেন।
(হয়তো ওই জ্ঞান নমোশুদ্রের জন্য হারাম, তাই।)

’বড়’দের নিয়ে এলার্জি আরও বাড়ল। কমাতে পারলাম না। নিজের অপমান নিজে লেখা বোধহয় আরও অপমানজনক। আবার, বিপরীতে, মান ও অপমান এত ঠুনকোও নয়, যে, কেউ আঁচল ধরে টান দিলেই সেটা খসে পড়ে। অন্তত আমি মনে করি,
রাস্তায় চলবার সময় একটা নেড়ি সারমেয়’র ‘ঘেঁউ’ করে ওঠায় আমার জাত যায় না। জাত তারই প্রকাশিত হয়।

বড় দাদা, আপনি আজকে বড় হয়েছেন। আপনি এই লেখা পড়বার সময় পাবেন না। তাই নিজের অন্যায় ও অভব্যতা জানবার সুযোগ পাবেন না। অবশ্য, বিনা পয়সায় ভদ্রতা ও বিনয় শেখার মতো সুযোগ আপনিও ডিজার্ভ করেন না। তাই আপনি আপনার মতো থাকুন। আরও বড় হোন। তবে দোয়া করি, আপনার সবকিছুই এত বড় হোক, যে, সেগুলো আর অবগুন্ঠনে না আঁটুক। প্রকটভাবে দৃশ্যমান হোক। আপনার অহংও এত বড় হোক, যেটা আপনাকে পদে পদে পরিচীত করাক।
’বড়’দের এই স্বভাবের কারনেই আমি স্বভাবত ও সাধারনত Crowd Learning এবং Open sourcing of job এই দুটো নীতি মেনে চলি। আমি বিশ্বাস করি, লার্নিং এবং চাকরির সুযোগ অতি অবশ্যই উন্মুক্ত থাকা উচিত।

পূর্ণিমার পূর্ণ শশীর সহিত পিরিত পাতাইবার উয্যুগ করিবার পূর্বে জানিয়া লইও,
সেই পূর্ণচ্ছটা শশী তোমাকে প্রিয়রূপে লইবার কোনো এরাদা আদৌ পোষণ করিয়া থাকেন কিনা।
অন্যথায় নেহাতই শরম পাইবে।
মনে রাখিও, তৈলে জলে মিশে না।

ছোট বেলার ভাবসম্প্রসারণ মনে আছে? কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে-ভাই বলে ডাকো যদি, দেব গলা টিপে-হেন কালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা-কেরোসিন শিখা বলে, এসো আমার দাদা।কিংবা ”শক্তের ভক্ত নরমের জম-বলে গেছে কানা আজম”। আমাদের নৈতিকতা বা সততার মাপকাঠি কী? অপরাধীর পদ, পদবী নাকি এথিকস?বড় বাবু গরিবের ঘরে আগুন লাগালেন-সবাই তাকে সাধু সাধু করে বাহবা দিলেন তার অসাধারন আগুন প্রজ্জলন কারিশমায়।আর কেষ্টা বেটা সেই পোড়া ঘর হতে একটা আধাপোড়া আলু লবণ লাগিয়ে যেই খেতে গেল অমনি তাকে অবৈধভাবে অন্যের সম্পদ লুন্ঠনের অপরাধে ১৪ বছর জেল।ম্যান ইজ মরটাল-মানুষ মাত্রই ভুল হয়।

(এই লেখা পড়ে কারও অফেনডেড হবার দরকার নেই। আপনি যদি এই লেখা পড়ে থাকেন, ধরে নিন, এটা আপনাকে উদ্দেশ্য করে লেখা নয়। এটা ভগবানকে উদ্দেশ্য করে এক অস্পৃশ্য ছোটজাতের মানবের অনুযোগ মাত্র।)

দুই.

’বড়’দের নিয়ে সবার মতো আমারও সবসময় অনেক কৌতুহল কাজ করত।
বড় মানে-
বয়সে যারা বড়
হ্যাডোমে যারা বড়
কড়ির জোরে যারা বড়
মাসল পাওয়ারে যারা বড়
স্টাটাসে বড়
ক্লাসে বড়
বিদ্যায় বড়-
সবাইকে নিয়েই কৌতুহল।
পেশায় ও ক্যারিয়ারে যারা বড়সড়, ফেসবুকে যারা বিশাল মহিরুহ, ফেসবুক সেলেব যারা-এমন স্টার পেশাজীবিদের সম্পর্কে ফেসবুকের নিয়ম অনুসারে যদি আপনি চোখ বন্ধ করে অতি অতি উচ্চাশা পোষণ করে মরতে থাকেন, তার দায় আপনার। যদি মনে মনে মন কলাই খান আর ভাবেন, আমার দেখা সব ফেসবুক স্টার স্যাররা সব গান্ধীজির মতো বিশুদ্ধ ও ঐশ্বরিক পবিত্রতার মূর্ত প্রতিক-তার দায় কেবলই আপনার।
হুশে আসুন বস।

আমরা ’বড়’রাও অফিস পলিটিক্স করি।
আমরা ’বড়’রাও পেছন হতে ল্যাং মারা খেলি।
আমরা ’বড়’রাও আরও বড় চেয়ারটার জন্য লালায়িত হই।
আমরা ’বড়’রা কোনো ছোটোলোক সামান্য নাম কামালে ইর্ষান্বিত হই।
আমরা ‘বড়’রা ছোট কেউ উপরে উঠছে-দেখলে ভীত হই।
আমরা ’বড়’রা এখনো চেয়ার, ফিতা কাটা, পুস্পার্ঘ পেলে বর্তে যাই।
আমরা ’বড়’রা এখনো চিপ, চিফ, ব্রিফ-তিনে মুগ্ধ হই।
আমরা ’বড়’রা এখনো ‘ছ্যাড়’ শোনার জন্য মাঝে মাঝে ফ্লোর দিয়ে হাঁটি।
আমরা ‘বড়’রা এখনো সালাম না দিলে তেলেবেগুনে জ্বলি।

আমি কি ‘বড়’ বিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছি?

না তো। আজকে এক ভাই একটা অনুষ্ঠানে বৃন্দে হতে আমন্ত্রণ করলে নতুন করে মনে পড়ে গেল, আরেহ, আমিও বোধহয় তাহলে ‘বড়’ হয়ে গিয়েছি। তাই মিলিয়ে দেখলাম, আমার চরিত্র আর মনটা বড় হয়েছে কিনা। দেখলাম, না, সবই মিলমতো আছে।

তিন.

বড় বড় মানুষদের নামগুলোও জলদগম্ভীর, রাশভারী, অভিজাত ও উচ্চমার্গীয় হয়ে থাকে।
আপনি আপনার সমস্ত জ্ঞানগম্মি প্রয়োগ করেও তার মর্ম উদ্ধার করতে পারবেন না।
যেমন ধরুন, অমুক সি.ই.ও, তমুক কোম্পানীর মার্কেটিং লিড, সমুক MNC’র হেড অব এইচ.আর;
এনাদের নাম হবে-
সাইরাজ আজমান নিমকজাদা;
সুরাজ সনাম কেশওয়ালা;
বারিশ একামান তুকমান;
মমরেজ চৌধুরী;
নারী হলে- আলিয়ানা তাকিয়ান রেশা;
এমন সব গুরুগম্ভীর নাম।
নাম দেখেই আপনার মধ্যে একটা ভয়জনিত বিনয় ভাব তৈরী হবে। হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ানোর আগে দশবার ভাববেন। বাড়ালেও আগে হাত প্যান্টের পেছনে দশবার মুছে তারপর ইয়া মুকাদ্দেমু বলে সামনে হাত বাড়াবেন।
তাদেরকে তাদের গুরুগম্ভীর ভাবমূর্তীর জন্য সহজাতভাবেই ভয় লাগবে। তাদেরকে ভয়জনিত স্ব-আরোপিত প্রজ্ঞাবান তকমা দিয়ে বসে থাকবেন। নিজের বাপের নাম তাদের কাছে বলতে হলেও ভয় করবে-পাছে, আপনি নিজে হয়তো নিজের বাপের নাম জানেন না, যেটা হয়তো তিনি জানেন।

চার.

একটি শোনা গল্প। এটি শোনা গল্প। ভুলত্রূটি মার্জনীয়। ১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি নাসার স্পেস সেন্টার পরিদর্শনে গেলেন। সেখানে তিনি একজন ক্লিনারকে দেখলেন ঝাড়ু হাতে যেতে। তিনি তাকে থামালেন আর জিজ্ঞেস করলেন, “হেই, আমি কেনেডি। আপনি কী করছেন? ”ওয়েল, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি চাঁদে মানুষ পাঠাচ্ছি।”-ক্লিনারের উত্তর।

একটি প্রতিষ্ঠানে কোন বিভাগের অবদান, গুরুত্ব কতটা-তা নিয়ে মাঝে মাঝে আমরা ছেলেমানুষি তর্কবিতর্কে লিপ্ত হই। প্রতিষ্ঠানে নিজের পজিশন ও ডিপার্টমেন্টের অবস্থান নিয়ে যুক্তি দেখাই।

“আমার ডিপার্টমেন্ট সবচেয়ে সেরা বা সবচেয়ে প্রায়োরিটাইজড” এমন অনুভূতিও হয়তো কাজ করে মনে মনে। কিন্তু বাস্তবতা হল, নাসার একজন ক্লিনার যেমন মনে করেন, প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কর্মযজ্ঞের একটি ক্ষুদ্র অংশ তিনি করলেও তিনি ওই বিশাল কর্মযজ্ঞের End Goal (চাঁদে মানুষের পদার্পণ) এর অন্যতম ভাগিদার।

তাই সেই অর্থে তিনি নিজেও একজন এস্ট্রোনটই, কারন তার কাজটি ওই স্পেস সেন্টারের জন্য সৃষ্ট কাজসমূহেরই অংশ। জানেন কিনা, আমাদের দেশে একজন বাস ড্রাইভারের সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা যে অত্যন্ত নিচু পর্যায়ের, তার বিপরীতে পশ্চিমে একজন বাস ড্রাইভারের বেতন ও মর্যাদা অত্যন্ত বেশি। তার কারন, তারা যেকোনো কাজকে শ্রদ্ধা করে, সমান গুরুত্ব দেয়। প্রতিটি বিভাগ, মানুষ, কর্মী প্রতিষ্ঠানের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ন। কারো অবদানের গুরুত্ব কম নয়, বেশিও নয়। কারো সম্মান ও মর্যাদাই বিন্দুমাত্র কম নয়। একজন ক্লিনার হতে সিইও-সবাই প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিতে সমান।

একটি প্রতিষ্ঠানে একজন তারকার নিখাঁদ অবদান বা মূল্য সংযোজন আসলে কতটা, বা, ঠিক কী এক্সপেকটেড?

আমি দুটি ’জায়ান্ট’, ‘সুনামধন্য’, ‘আরাধ্য’ ও ‘মুল্টিন্যাশনাল’ এর অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে ভাবছি।

দুই জায়ান্টেরই দুইজন সুপারস্টার ‘প্রধান গো-রক্ষক’ মানে ‘মূখ্য দানবসম্পদ কেরাণী’ রয়েছেন।

দুই প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মীদের ‘ন্যায্য’ ও ‘আইননানুগ’ অধিকার হরণের জন্য ‘কুখ্যাতি’ পেয়েছে। আবার, উভয়েই তাদের চাকচিক্য ও ‘সহমতভাই’ পর্যায়ের সুশীল ক্রিয়াকলাপের জন্য নামজাদা।

কথা হল, এই সুপারস্টার দানবসম্পদ কর্তারা আসলে ততোধিক সুপার জায়ান্টে ঠিক কী কী যোগ করতে সক্ষম, বা, সত্যি সত্যি ঠিক কতটা যোগ করে থাকেন?

নাকি ফিতা কাটা আর ঝুটক্যাম্পই সই?

এক সুপারস্টারকে চিনি। আরেক সুপারস্টেশনে গিয়ে পায়খানায় হ্যান্ডড্রায়ার লাগিয়ে সেটাকে প্রমোটের নামে নিজের ঢোল বাজাতে গিয়ে তাৎক্ষণিক চাকরি হারান পরিণামে।

সুপারস্টেশানে সুপারস্টার হয়ে আমরা কি সুপারস্টিশাস কিছু আদৌ করি? বা করবার চিন্তা কি থাকে? করবার অবকাশই কি থাকে?

নাকি পুরোটাই গিমিক? পুরোটাই রেটোরিক? পুরোটাই কেবলই ব্যক্তিগত অর্জনের নামাবলি মাত্র?

জানা বিষয়ের নতুন ও চোস্ত একটি নাম শিখলাম কাল-Pedigree Hiring

এই টার্মটিকে স্থিরভাবে ধরবার চেষ্টা করছিলাম অনেক দিন ধরে। হয়ে উঠছিল না। চ্যাটজিপতিকে কাল বললাম, আমি ঠিক এই এই রকম একটা কনসেপট নিয়ে ভাবছি। এটাকে এক কথায় কী বলা যায়। সে টার্মটা বেছে বের করে দিল। বাহ!

কী সেই পেডিগ্রি হায়ারিং?

নতুন কিছু না। আমি যেটা নিয়ে অনেক অনেক কথা বলি-সেটাই। বংশলতিকা।

একজন প্রফেশনাল, বিশেষ করে সিনিয়র পজিশনার, তাকে হায়ার করবার সময় কেবলমাত্র, শুধুমাত্র, একমাত্র, মূখ্যত, সাধারনত-

১. তার স্টারডম

২. তার বাজার স্টেক

৩. তার জনপ্রিয়তা

৪. তার সাবেক প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড ইকুইটি

৫. তার বিশ্ববিদ্যালয়

৬. তার জেন্ডার

৭. তার রেফারেল ভ্যালু

৮. তার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপিয়ারেন্স ও গিমিক

৯. অ্যাবসলুট থার্ড পার্টি সিলেকশন

১০. ইন্টারভিউতে দেখানো কোনো গিমিক বা চমক

১১. তার দীর্ঘ ক্যারিয়ার

১২. অথবা তার চুল, দাঁড়ি পাকা

এর যেকোনো একটিকে একমাত্র চলক হিসেবে ধরে তাকে ঘরে তুলে নেয়াকে বলে পেডিগ্রি হায়ারিং।

এই পদ্ধতির লক্ষ্য থাকে বাজার হতে স্টার, সেলেব, দেবতা, মুরব্বী, পীর হায়ার করা। তার তলানি থাক বা না থাক, আর, থাকলে আবার, তাকে ঘরে এনে কাজে লাগানো যাক বা না যাক, আগে হায়ার করো। লাগলে শোকেসে সাজিয়ে রাখা হবে। তবু সুপারস্টার হায়ার করো।

এই পেডিগ্রি হায়ারিংকে সুরুত করে কাজে লাগিয়ে অনেকেই দু’হাতে দুইয়ে নিচ্ছে কামধেনুর সুযোগ। আর হায়ারারবৃন্দ কীভাবে গজবে পড়ছেন-তা তো জানা কথাই। জানেনই তো, গরুর হাঁটের ৫০ মণ সাইজের গরু দেখতেই ব্রাহামা অথবা ব্রাহ্মন মাত্র। খেতে কিন্তু সেই দেশী ৩ মণী গরুই বেটার।

স্রেফ চুল, দাঁড়ি সাদা না বলে, আর দেখতে চ্যাংড়া লাগে বলে একটা ভাল চাকরি হয়নি না পাবার বঞ্চনা অনেকবার হয়েছে আমার। আর, চাকরি হবার পরে চুল, দাঁড়ি সাদা মুরব্বী নই বলে কাজ ও ড্রাইভের দাম পাইনি-এমন তো কত কত বার হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্যালেন্ট ও ভ্যালু অ্যাডিশন চাই না। তাদের চাই স্টার, মুরব্বী।

পাঁচ.

Influencer নামের একটি নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হলাম কয়েকদিন আগে, জনাব আশিকুজ্জামান সাহেবের কল্যাণে। সম্ভবত এর আগেও জনাব মাসুদ চৌধুরী ভাইয়ের নিকটও শুনেছিলাম। বাউন্সার, ফেন্সার নামগুলো আগে শুনলেও, ইনফ্লুয়েন্সার এবারই কানে বাজল।

জিনিসটা কী, তা এখনও জানি না। তবে ভাবে যতটা বুঝি, তাতে মনে হল, পজিটিভ বা নেগেটিভ-যেভাবেই হোক, কারো ওপর আছর করতে পারাটাই ইনফ্লুয়েন্সারের কেরেদ্দারি।
সেই অর্থে জ্বিন, পেত্নি, পরি (মনি)ও এক ধরনের ইনফ্লুয়েন্সার।

পাবলিক ফিগার, সেলেব, তারকারাও কার্যত ইনফ্লুয়েন্সার। ইচ্ছায় হোক, বা অবচেতনে।
কথা হল, সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে কেউ যদি তারকা বনে যান, আর ইনফ্লুয়েন্স করবার মতো কাবেলিয়াত অর্জনই করে ফেলেন, তাহলে কি তিনি একটা ঘেরাটোপে বন্দী হতে বাধ্য? তারকা বা ইনফ্লুয়েঞ্জা বনে যাওয়া মানেই কি তিন জনতার সম্পত্তি? তার নিজস্বতা তাহলে ফ্যানদের গণদাবীর কাছে বন্ধক? আমিও আসলে জানি না।

ব্যক্তিগতভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতার ঘোরতর সমর্থক আমার কাছেও দ্বিধা লাগে, যে, ব্যক্তিস্বাধীনতা কি সেলেব্রেটি বা ইনফ্লুয়েন্সারের জন্য হারাম, নাকি হালাল?

এই প্রশ্ন অমিমাংসিত থাক। তবে, সেলেব বা ইনফ্লুয়েঞ্জা মশাই যদি নিজেই কিছুটা দায় ও দায়ীত্ব নেবার কথা ভেবে নেন, তাহলে কিছুটা কাজে দিত। তাছাড়া, কেউ যদি তারকা খ্যতি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা পাওয়ার এনজয় করেনই, তাহলে ফ্যানদের ভুল পথে চালিত হওয়ার বিষয়ে কিছুটা দায় নিতে তো পারেনই।

বলছিলাম, ছোটবেলায় আমাদের কলোনিতে প্রচুর গরু পালন হত। দুধেল গাভী গরু। সংখ্যায় গোটা পঞ্চাশেক হবে, দশটা পরিবারে। তো, সেই পশ্চাশটা গরুর বিপরীতে এক পরিবারে একখানা বিশাল ষাড় পালন হত। মফস্বলে সেই ষাড়কে বলা হত এঁড়ে। শহরের ইন্সটাগ্রাম জেনারেশন বোধহয় ওটাকে পিটবুল নামে চেনে।

তো, এই একা ষাড় বাবাজিই ছিলেন গোটা পশ্চাশটি গাভীর জন্য একমাত্র ইনফ্লুয়েন্সার। মানে, যার যখন গর্ভধারনের বাতিক উঠত, তার জন্য এই পিটবুল বাবাজির ডাক পড়ত। পিটবুলের মালিক তার ষাড় বা এঁড়েকে নিয়ে হাজির হতেন। কখনো হাজিরও হতে হত না। গাভী ও ষাড় বাবাজি মিলে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করতেন। এহেন পিটবুল ঘুরে ঘুরে ওই পশ্চাশখানা গাভীর ইনফ্লুয়েন্সারের দায়ীত্ব নিয়ে নিয়েছিলেন। গরু মহলে তার বিশাআআআআল কাটতি।

গল্পের এই পর্যন্ত এসে যদি আপনি এই গল্পের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ের একজন পিটবুলের সাথে একে মিলিয়ে ফেলতে শুরু করেন, তাহলে ভুল করবেন। না, আমি হাইপে মাতা মানুষ না। আমি চলি যাকে বলে,

যব পুরে শেহের চলতা
বাইজী কি মাকাম কি তারাহ,
তব ম্যায় পেরেশান হু,
মেরে পাঁঠা কে লিয়ে ঘাস কাটকে কা। *যাচ্ছেতাই ফারসি শায়েরি।

না, সুপারস্টার সেলেবের পিটবুলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া নিয়ে আমি একটুও ভাবিত নই। ভাবিত নই, ওপাড়ের আশির্বাদধন্য জননীকূলকে নিয়েও। কিউপিড দেবতা দিচ্ছেন, তারাও হাত পেতে (আসলে পেট পেতে) নিচ্ছেন। লেনা ও দেনা। দোষ ভঞ্জন করতে হলে উভয় তরফেরই করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে শুধু কলিযুগে কেন, আশির দশকে জৈনক লে.জে সাহেবও শুনেছি সেকালের ইনফ্লুয়েন্সারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কথা বললে তো তাকে নিয়েও বলতে হয়।

আমি বাপু আবার ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসি। কে আশির্বাদ দেবেন, কে হাত পেতে নেবেন-আমার কী? বেল পাকলে কাকের কী? বিশেষত যখন জানি, নৈতিকতা আর সামাজিকতার ধুঁয়া তোলা আমজনতার এতটা উত্তেজনা ও ক্ষোভের কারনটা নৈতিকতা না, বরং
“ইশশ, ওই পিটবুলটা কিংবা আফ্রোদিতিটা কেন আমি, কেন আমি হলাম না?”

মানুষের শরীরের তো মৃত্যু হয়। কিন্তু, যদি বলা হয়, একজন জীবন্ত মানুষ জীবন্ত অবস্থায় কীভাবে মরে?
যখন তার স্বপ্নটা মরে যায়। যখন তার প্রত্যাশাটা মরে যায়। #deathofdream

একটি দেশ তখন মরে যায়, যখন তার জনগনের স্বপ্ন, প্রত্যাশা, চাহিদার মৃত্যু হয়।
যখন তাদের ব্রেইন, বিবেচনাবোধ, রুচি, পছন্দ, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গী এবং……………..জাজমেন্টের মৃত্যু হয়।
তখন কী ঘটে?

তখন সেই জাতি গোলাপের চেয়ে ঘেঁটুফুলকে বেশি দাম দেয়।
সেই জাতি তখন কর্কশীট চিবিয়েই ইক্ষুরসের ফিল পায়।
সেই জাতি তখন প্রকাশ্য রাস্তায় সঙ্গমরত কুকুর অথবা প্রকাশ্যে রতিক্রিয়ায় রত দো-পেয়ে মানুষদের বালখিল্যতাজনিত সৃষ্টি বা অনাসৃষ্টিকেই কালচার, স্টাইল, সভ্যতা ভাবা শুরু করে।
সেই জাতি তখন জিরো মলম বা অত্যন্ত খলিলের ছিঃনেমাকেই অস্কার মুভি ধরে নেয়।
সেই জাতি তখন চটি বইকে নোবেলজয়ী সাহিত্য হিসেবে ট্রিট করে।

সবচেয়ে বড় কথা, এগুলোকেই তারা তখন ভাগ্য বা সৌভাগ্য বলে বিশ্বাস করা শুরু করে।
এহেন ব্রেইন পঁচা বা মরা জাত যে তাদের প্রধান প্রধান আইডল, নেতা, পীরদের দেবতার আসনে বসাবে-তাতে অবাক হবার কী থাকে? বিকৃতি ও অধঃপতন যে তখন পূজনীয় হবে-তাতে আর আক্ষেপ কী?


টপ পজিশনারদের চিন্তন বিদ্যার উৎকর্ষ কেন জরুরী?:

নিউ হায়ারিংয়ের সময় ক্যানডিডেট যে অপ্রকৃতস্থ নন, বদ্ধ উন্মাদ নন, অসংলগ্ন চিন্তার মানুষ নন, পারভার্ট নন, মধ্যযুগীয় কুপমন্ডূক চিন্তার মানুষ নন, ফ্রাস্ট্রেটেড মৃগী রোগী নন, ভুল দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ নন, জঘন্য রকম নিচু লিডারশিপ কোয়ালিটির মানুষ নন-সেটা যাচাইয়ের একটা ম্যাশিন বা রোবট বা বট অথবা নিদেনপক্ষে একটি Magic Mirror যদি থাকত, তাহলে অনেক অনেক মানুষ বেঁচে যেত।

অনেক জুনিয়রের চাকরি জীবনটা সুখের হত।

অনেক কোম্পানী দেউলিয়া হবার হাত হতে বাঁচত।

নতুন মানুষ হায়ার করবার সময় নজর রাখুন, যে, লোকটার মধ্যে স্বপ্ন ও আশাবাদ বেঁচে আছে কিনা।

বাংলাদেশে প্রায়ই দেখবেন, বড় রাস্তা তৈরী হয়েছে, বা মেরামত হয়েছে। ঝা চকচকে। কিন্তু, রাস্তার একদম মাঝখানে একটা খাম্বা আগের মতোই রয়ে গেছে। নেপথ্যে ক্যাপশন, কনট্রাকটরের কাজ রাস্তা বানানো, সে বানিয়ে দিয়ে গেছে। ইলেকট্রিসিটির অফিসের এই প্রোজেক্টে কাজ নেই, তারা কিছু করে নাই। আর তারা জানলেও তাদের ঠেকা পড়ে নাই নিজে যেচে এসে খাম্বা সরাবে। তাছাড়া, খাম্বাসহ রাস্তা হলে পরে সেই খাম্বা সরাবার আলাদা প্রোজেক্ট আসার ব্যাপার আছে, খাম্বা সরাতে রাস্তা কাটা পড়লে আবার রাস্তা বানাবার অফিসেরও নতুন করে প্রোজেক্ট পাবার (তথা পয়সার ঝনঝনানির বিষয় আছে।)

স্বপ্নহীন, উদ্যমহীন, ফ্রাস্ট্রেটেড মানুষ-সেটা বিভিন্ন জবে, বিশেষত সিনিয়র লিডিং পজিশনে হায়ার করা নিয়ে আমি প্রচুর প্যাঁচাল কেন পাড়ি তার একটা উদাহরণ দেখাবো। বিশেষত ডিমরালাইজড বা ডিমোটিভেটেড মানুষকে যে আমি অ্যাটোম বম্ব বলি, সেটার একটা আঁচ করতে পারেন ছবি হতে।

একটা রেনোভেশন ওয়ার্কের উদাহরণ এটা। পুরোনোটা বদলে নতুন কিছু একটা প্রতিস্থাপনের ঘটনা এটা। যার কাজটা করার কথা, সে সেটা করে দিয়ে গেছে। টপ গাই, যার কাজটা তদারকি করার কথা, সে কাজ শেষের পরে নিজে এসে দেখে যায়নি, কাজটা ঠিক কীরকম হয়েছে। কারন, তার অত উৎসাহ নেই। তাছাড়া, এত তুচ্ছ কাজে তিনি মাথা দেবেন কেন, তার দশটা অফিসার থাকতে?

আবার, প্রতিদিন যেসব নিম্নবর্গের মানুষ এখানে মেইনটেইন করবার দায়ীত্বে থাকে, সে এটা দেখে নাই, বা, দেখলে অসঙ্গতিটা ধরতে পারে নাই, বা, পারলেও গা করে নাই।

আর, এই দুই ডিমরালাইজড গ্রুপের অত্যাচারে মরালিটি ডাউন হওয়া সাধারন জনতাও দেখেও কাউকে রিপোর্ট করে নাই। ফলাফল তো দেখছেন।

এটা স্রেফ একটা উদাহরণ মাত্র। কথা যখন বললামই, তখন পুরোনো আরেককটা কানেকশনও রিপিট করি।

ধরুন, আপনার অফিস রুমে বসার যায়গাটার পাশেই একটি ছোট্ট স্পেস আছে। একদিন মনে হল, ওই যায়গাটায় একটি কাঠের সাইড টেবিল বা ক্যাবিনেট দিলে সুন্দরও হবে, দরকারও সমাধা হবে।

কাঠমিস্ত্রীকে ডেকে বলুন। সে আপনাকে রাতারাতি একটা সাইড র‌্যাক বানিয়ে জায়গা ফিল দেবে। সেখানে আপনার ঘটিবাটিও রাখতে পারবেন। পারপাস সার্ভড।

কিন্তু একই মনোবাসনা একজন ইনটেরিয়র ডিজাইনারকে বলুন। সে আপনার সাইড টেবিলের দরকার তো পূরন করবেই, সেই সাথে কারিকুরি যোগ করে সে ওই ক্যাবিনেটের ভেতর দিয়ে আপনার কক্ষে একটা সৌন্দর্যও যোগ করবে। একে বলে মাস্টারস্ট্রোক বা ক্লাসিক জব।

যার যেটা কাজ, সেটা তাকে দিন। এবং, সম্ভব হলে, সব সিদ্ধান্তে বা সব দরকারে একাডেমিক বা ক্লাসিক ওয়ার্কারদের নিতে চেষ্টা করুন। হাতুড়ে বা প্রাকটিশনার আপনার পেটের বেদনার চিকিৎসা করে ব্যাথা কমিয়ে দিতে পারবে ঠিকই, কিন্তু এপেনডিক্স সার্জারি করতে পারবে না।

নিজে নিজে শিখে তবলা বাদক হতে পারবেন, ”বন্ধুর বাঁশি বাজে রে, আমার কানে কানে”-গানের সুর বাঁশিতে বা তবলায় তুলে দর্শকের বাহবা পাবেন। কিন্তু কখনো ধ্রূপদি বাদক হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া বা রাজেন্দ্রপ্রসাদ হতে পারবেন না। (যদি না আপনি রবীন্দ্রনাথ কিংবা মোজার্টের উত্তরপুরুষ না হোন। তবে মুশকীল হল, একজন স্বশিক্ষিত আলভা এডিসন কিংবা কাজি নজরুল গন্ডায় গন্ডায় পয়দা হন না।)

কপি-পেস্ট কিংবা “ছায়া অবলম্বন” করে চটির লেখক, কিংবা বড়জোর ফেসবুক লেখক হওয়া সম্ভব। কিন্তু, একজন হুমায়ুন আহমেদ কিংবা শামসুর রাহমান হওয়ার জন্য গ্রামার দরকার, সবক দরকার, রেয়াজ দরকার, মহড়া দরকার, একাডেমি বা ওস্তারেদ সঙ্গ দরকার, আরও আরও অনেক কিছু দরকার।

তবে, খেয়াল রাখতে হবে, পরিস্থিতি কী চাইছে, কিংবা, পরিস্থিতির চাহিদা কী। ঘরে আগুন লেগেছে। তখন যদি আবার আপনি মনে করে, এই কাজে তো ফায়ার সার্ভিসই সবচেয়ে ওস্তাদ। তাদের আসা অব্দি অপেক্ষা করি। যা করার ওরাই সুন্দর করে করবে। তাহলে সব শেষ।

ওদের আসতে দিন। কিন্তু, তারা আসতে আসতে হাতের কাছে পানি বা বালু যা আছে, তাই নিয়ে আগে নিজেই চেষ্টা শুরু করে দিন।

বিদ্যমান কর্মীদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই সার্ফিং করে দেখুন, কেউ ফ্রাস্ট্রেটেড আছে কিনা।

স্বপ্নহীন, আশা বিহীন আর ফ্রাস্ট্রেটেড মানুষ-একটা জান্নাতুল ফেরদৌসকেও জাহান্নাম বানিয়ে ফেলতে পারে।

একজন ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ও ভুল চিন্তাশক্তির মানুষ, তিনি অন্যভাবে যতই যোগ্য, চৌকষ, কর্মক্ষম, দক্ষ, সফল বা কনট্রিবিউটিং হন না কেন; যতই তার সফলতার ঝুড়িতে ঘন্টা বাজুক না কেন;

তিনি, তার কাজ ও অবদান আসলে ধ্বংসাত্মক।

দিনকে দিন, তিনি ও তার সৃষ্টি প্রতিষ্ঠানকে সামনে নয়, পেছনে নিতে থাকে।

প্রশ্ন করতে পারেন, একটা কোম্পানী একই সময়ে ওপরে উঠছে অথচ ধ্বংস হচ্ছে-সেটা আবার কীভাবে হয়?

একদম গেঁয়ো ও কাঁচা একটা উদাহরণ বলি। একটি প্লেন যখন ল্যান্ড করে, তখন সে কিন্তু গতিশীল থাকে, সে সামনে আগে বাড়তে থাকে। আবার, একইসাথে, সে কিন্তু, ক্রমান্বয়ে মাটির দিকেও নেমে (পড়ে) যেতে থাকে। তার সম্মুখ গতি আর পতনের গতি একই সাথে ক্রিয়াশীল হয়।

তেমনি, আপনি দেখবেন, তার নেতৃত্বে সেল বাড়ছে, প্রফিট হচ্ছে, নতুন বিজনেস গড়ছে। সবই ঝকমকে। কিন্তু, তারপরও, কোম্পানী পড়ছে। পড়ছে। পড়ছে।

থট লিডারশিপ ম্যাটারস। থট ম্যাটারস।

একজন মানুষ, যার কোনো অ্যামবিশান নেই, ক্যারিয়ারিস্ট নন, আর যার ক্যারিয়ার গ্রোথ নিয়ে আর কোনো স্বপ্ন বেঁচে নেই-এমন মানুষকে হায়ার করলে, এবং বিশেষত উঁচু পদস্থ দায়ীত্বশীল পজিশন দিলে আপনার প্রতিষ্ঠানের অধঃপতন ছাড়া উন্নতি হবে না।

স্বপ্নহীন ও আশাহীন মানুষ নিরব বিষের মতো।

প্রসেস, টিম ও প্রতিষ্ঠানের মাথায় যদি কূপমন্ডূক, গোঁড়া, সেঁকেলে, স্থুল, নেগেটিভ ও ফ্রাস্ট্রেটেড মানুষ কোনোমতে বসে যায়, তার কামড় দীর্ঘমেয়াদী।

ধরুন, আপনার প্রতিষ্ঠানের হেড অব এইচ.আর একজন ‘বিদায় রাহাবার’ ভক্ত। তার রাজত্বে আপনাদের ভাগ্য কী হতে পারে? তেমনই।

ওল্ড স্কুল ফোকসরা মাথায় বসে থাকলে কর্মীদের ত্রিশঙ্কূ অবস্থা ঠেকানোর ক্ষমতা HR এর নেই। অবশ্য খোদ HR নিজেই যদি তদীয় গোত্রের হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই।

খোদ HR ই তখন ওই লোকেদের সাঙ্গপাঙ্গ বনে যাবে, আর সবরকম প্রগতির পথ বন্ধ করে দেবার জন্য বাদবাকিদেরও সাথে নিতে ডাকবে-

”আহো, ভাতিজা আহো।”

একটি কাল্পনিক ঘটনাচক্রের কথা ভাবুন তো।

মনে করুন, আপনার HR টিমে আপনি একজন Diversity & Inclusion অফিসার নিয়োগ করলেন। যার কাজ হল, আপনার টিমে ও কোম্পানীতে ডাইভারসিটিকে প্রমোট করা এবং ইনক্লুসিভ কর্মপরিবেশ প্রমোট করা।

এখন, ঘটনাক্রমে, দেখা গেল, যে, ওই Diversity & Inclusion অফিসারের ব্যক্তিগত দর্শন হল-

১. “মাইয়া মানুষ অইল তেতুলের মতো………….।”

অথবা,

২. “বারচিটির ফ্রি মিক্চিং’ এর মেয়েছেলে বিয়ে করলে আমি আমার সন্তানের জন্য লজ্জাশীলা মা উপহার দিতে পারব না।”

এহেন অবস্থায় ওই Diversity & Inclusion অফিসার হতে আপনি কী কী কনট্রিবিউশন, পারফরম্যান্স আশা করতে পারেন?

অদ্ভুৎ শোনালেও এটা সত্যি, যে, প্রচুর (বা কিছু) HoHR অথবা তথাকথিত HoHR.A.C আছেন, বিশেষ করে সবচেয়ে শ্রমঘন ও শ্রমবিশালত্বের একটি সেক্টরে; যারা নিজেরাই, এই ২০২৪ সালের পৃথিবীতে বাস করেও বিশ্বাস করেন, যে,

”মাইয়া মাইনষের চাকরি করন উচিত না। হেরা ঘরে বইয়া বাচ্চা পালব, স্বামীর জন্য পাক করব আর উল বুনব।”

মুরগী বর্গা দেবার আগে দেখে নিন, বর্গীটা কে।

একদিন রাতে বাসে করে বাসায় ফিরছি। বাসের জনা পচিশেক যাত্রীর মধ্যে অধিকাংশই গার্মেন্টস এর। তাই যথারীতি চারপাশে “বস স্যাম্পলটাতো দিলেন না”, “…..পো, এখনও ওয়াশে পাঠাস নাই ক্যান”, স্যার আমি তো বাইর হইয়া গেছি, কালকে দেই” ইত্যাদি আলাপে মুখরিত। আমি চুপচাপ আমার পেছনের সিটে বসা দুই ভদ্রলোকের কথা শুনছি। তারা দু’জনেই বাংলাদেশের একটি বিশাল গ্রুপে কর্মরত (নামটি বললাম না)। তাদের কথার বিষয়বস্তু কর্মী মূল্যায়ন।

একপর্যায়ে একজন প্রশ্ন করলেন “অমুক সাহেবকে এত বেতনে কেন রাখা হচ্ছে”। তাদের অন্যজন বললেন, “ভাই, কর্মীরা যখন কোম্পানীতে অনেক সিনিয়র লেভেলে চলে যায় তখন তাদের শারিরিক/ক্ল্যারিক্যাল শ্রম কমিয়ে দেন। তাদেরকে দীর্ঘদিন ধরে যে কোম্পানী এতটা পর্যায়ে নিয়ে এসেছে তার কারন হল তারা তখন তাদের এতদিনকার লব্ধ প্রফেশনাল নলেজকে কাজে লাগিয়ে কোম্পানীকে আইডিয়া সরবরাহ করবেন।

তারা তখন শ্রম নয়, কোম্পানীর কাছে তাদের আইডিয়া বিক্রি করেন।” আমি একজন এইচ আর প্রফেশনাল হিসেবে নতুন করে বিষয়টি উপলব্ধি করলাম। কোম্পানীতে যারা টপমোস্ট পজিশনে কাজ করেন তাদেরকে হতে হবে আইডিয়া সেলার, ট্রাবলশুটার নয়। লিডিং লেভেল কর্মীদের হতে হয় ভিশনারী। একমাস, একবছর পরের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের আজকে উপলব্ধি করার, প্ল্যান করার মতো ক্যাপাবিলিটি না থাকলে তাদের কোনো লিডার এর ভূমিকায় নিযুক্ত করা কোম্পানীর জন্য আত্নঘাতি হবে।

আমরা নিম্নপর্যায়ে যখন কর্মী নিয়োগ করি তখন তার বেসিক পড়াশোনা, কম্পিউটার জ্ঞান, চেহারা, কথার ধরন-মোটামুটি ইত্যাদি দেখে থাকি। কিন্তু টপ লেভেলে এসব বেসিক বিষয়ের সাথে আরো যেসব কোর ইস্যু আমরা দেখতে চাই তার মধ্যে আছে তার ভিশনারী পাওয়ার, সৃষ্টিশীলতা, নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা, সাহস, উদ্যম, এনার্জী, জনসংযোগ, টীম স্পিরিট-এসব। আজকে যখন নিম্নপর্যায়ের কর্মীদের জন্যই আর তেমন যাচাই-বাছাই’র সুযোগ সীমিত তখন উচ্চপর্যায়ে এত অ্যাবসট্রাকট গুণাবলি/যোগ্যতা যাচাইয়ের সুযোগ ও প্রয়োজনীয়তা কই?

আমাদের নিজেদের, কর্মীদের, সহকর্মী বা সাবর্ডিনেটদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা না থাকলে আমরা সেটি নিয়ে কনসার্নড হই। তবে, কখনো ভেবে দেখেছেন কি, আমরা আমাদের বা টিমমেটদের ভিশন না থাকা নিয়ে ভাবিত হই কিনা?

ভিশন কী?

গভীর ও বিস্তৃত এ্যঙ্গেলে ভাবা ও চিন্তা করার ক্ষমতা,

পরিণতি ও প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারার ক্ষমতা,

একটি বিষয়কে ত্রিমাত্রিকভাবে ভাবার ক্ষমতা,

স্বপ্ন দেখা ও দেখানোর ক্ষমতা,

যুগের থেকে এগিয়ে থাকার ক্ষমতা,

এই এ্যবিলিটি না থাকলে তার দক্ষতা ও প্রাজ্ঞতা আপনাকে খুব বেশি দূর ও দিন এগিয়ে নিতে পারবে না। পদে পদে তিনি আপনাকে পেছনে টানবেন, ডুবাবেন। নিজের ভিতরে ভিশন পাওয়ার সৃষ্টি করুন। ভিশনারী কর্মী ও টিমমেট প্রমোট করুন। টিমে ভিশনারী কাজ ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দিন।

joblinkingbyseniors #juniors #bigshots #newcomer #professionalism #corporateidolsicons #contribution #socialobligation #talentacquition #talentmanagement #interviewhacks #employment #joblinking #approach #careeraid #patience #perseverance #competition #envy #careerblockage #jealous #joblinkingbyseniors #bigshots #socialobligation #reference #mentoring #careeraid #jobsecurityofseniors #bigshots #womenatwork #femism #workingwomen #financialsolvency #financialsecurity #employability #jobless #contingency #getinterviewcall #crackinginterview #increaseinterviewchances #failureininterview #interviewfailure #increaseinterviewsuccess #costoptimization #shrinkingemployment #illtrend #exploitation #utilizingseniors #bigshots #mentoring #socialplatforming #evaluationoftalent #evaluationofseniors #mutualinterest #sugardady #pampering #industryacademiacollaboration #corruption #bribe #evilearning #ethics #advisory #personaldevelopment #secondincome #consultancyservices #trainingasaprofession #keywords #buzzwords #Adviser #guru #pioneer #Focusgroupstudy #Routecauseanalysis #Criticalpathanalysis #jargon #freespeech #freeconsultancy #freementoring #freetraining #seniors #bigshots #rank #status #generalmanager #careerism #professionalism #initiative #beyonddream #pride #exposer #showoffatitsbest #daydream #lowercast #highercast #cultclassic #obscure #seniorship #bigshots #elders #giants #arrogant #pride #rudeness #missbehave #star #celebrity #icon #influencer #Leadershipquality #Leadershiptraits #thoughtleadership #Thinkingability #qualityofthoughts #Diversityinclusion #inclusiveworkplace #valueofidea #seniorship #bigshots #valueaddition #permissiveness #liberalismofseniorleaders #futuristicvision #thoughtprocess #frustratedleader #DEIB #diversity

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *