সম্মানের ও স্নেহের অনুজ ফয়সাল ভাই বরাবরের মতো সেদিন চেপে ধরেছেন-বই বের করতে হবে। আমার অলসতার খোঁজ তিনি জানেন বলেই একদম আটঘাট বেঁধে তারপরই আমাকে ধরেছেন। ভদ্রতা ও ভালোবাসার একটা অদৃশ্য চাপ থাকে। আমি অভদ্রের মতো সেই চাপও উপেক্ষা করে ফয়সালকে বলতে পেরেছি, “না ভাই, এবারও বই বের করব না।”
দুঃখিত ফয়সাল। সামনের দিনে হয়তো হবে।
’বই লেখা’ নামের কোনো কাজে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাসী নই। শুনেছি, আজকাল মানুষ কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প লেখে না। সবাই বই লেখে। লেখার চেয়ে বই বের করায় আমাদের বেশি উৎসাহ ও নজর। আমি এত কাবেল হতে পারিনি বলে বই লিখি না।
নিজের আত্মার ডাককে ভুলে তবু এর আগে দুয়েকটা বইয়ে লেখা দিয়েছিলাম। ক্ষণিকের আবেগে, ভুলে, সুনামের লোভে। এখন বড্ড শরম বোধ হয় সেজন্য।
এক সুহৃদ আরেক লেখিকা আপার চমৎকার একটি লেখা আজ শেয়ার করেছেন। বই প্রকাশ, বিনামূল্যে বা সস্তায় তার বিতরণ নিয়ে তার হৃদয়ের ক্ষোভ, হাহাকার তাতে ফুটে উঠেছে। আহা। আহা।
নিজের টাকায় বই প্রকাশ করে ভিখিরির মতো, নির্লজ্জের মতো, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে নিজেই আবার যখন তার Promo করতে হয়, দ্বারে দ্বারে বই বিক্রীর বা জোর করে কেনাবার জন্য লেখককেই ধর্ণা দিতে হয়, দেশ ও জাতি যখন বই লেখায় অভ্যস্ত হয়, বই লেখার চেয়ে আবার বই প্রকাশে বেশি মত্ত হয়, লিখিয়ে হবার চেয়ে যখন তারকা হবার দিকে বেশি মত্ত হয়, বই কেনার চেয়ে বই মেলায় বই হাতে সেলফীর পোস্ট দিতে বেশি অভ্যস্ত হয়, বইমেলার প্রকাশকদের মোট বিক্রীর চেয়ে যখন বইমেলার ফুঁচকা ও মুরগী ভাজার দোকানদারদের মোট বিক্রী কয়েকশত গুন বেশি হয়, যখন করোনার ভয়ে বইমেলা পেছানো গেলেও বানিজ্যমেলা চলতে থাকে, যখন ফেব্রুয়ারি এলেই কেবল বইয়ের পোস্টে ফেসবুক ভাসে, তখন, বই প্রকাশে ঘেন্না হয়। না, এই ঘেন্না হয় নিজের ওপর। নিজের অক্ষমতার ওপর।
তাই, ফয়সলকে ফিরাই। ফয়সলদের ফিরাই। এই বইহীন সমাজকে ঘেন্না করে, এই ভার্চুয়াল মস্তির সময়কে ঘেন্না করে, ইউটিউব ও ফেসবুক মস্তির কাছে পঠন ও লিখনের নির্মম হারকে ঘেন্না করে বই প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে না। বইকে যে দেশে ফেরি করতে হয়, সেখানে বইমেলা বর্জনীয়।
তবু হয়তো, খুব শীঘ্রই নিজের আত্মাকে বিক্রী করতে পারব। নিজেকে নিজের কাছে হারাতে পারব। লোভ ও আপোষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে সক্ষম হব। সেদিন আমিও বই লিখব। কবিতা নয়, গল্প নয়,
সেদিন আমিও ‘বই লিখব।’