Skip to content

”কার কাছে কই মনের কথা?”

”আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যকূল, শুধাইল না কেহ।”

আপনার মনের একান্ত কথাগুলো বলবার মতো কতজন আছে সংসারে? কে সে?

সংখ্যাটা যত ছোট, আপনি মানুষ হিসেবে ততটাই সূক্ষ্ণ, তবে একা।

আমরা আসলে অন্যের কথা শুনতে চাই না। অন্তত আমি মন দিয়ে কথা শোনেন-এমন মানুষ প্রায় কখনোই পাইনি। সবাই শুধু শোনাতে চায়। শুনতে না।

এমনকি, কেউ আপনাকে প্রশ্ন করল,

”এই বলো তো, তোমার হয়েছে কী? বা, তুমি আসলে কী বলতে চাও?”

এরপরও, সে আপনার কথাগুলো শুনতে চাইবে না।

মনের কথা তাই মনেই পঁচে মরে। অবদমিত কথা বলবার তাই এক বিকল্প মাধ্যম হল লেখা। লিখতে পারেন উন্মুক্ত মাধ্যমে।

কেউ না পড়ুক, লিখুন।

মজার বিষয় হল, প্রায়শই অচেনা, অজানা কোম্পানীর সেলস টিম হতে ফোন করে জানতে চায় মনের কথা। মানে, আমার মনে কী চায়-সেই কথা।

অবশ্য, কী চায়, না বলে, বলা যায়, তারা জানতে চান, আমার মন কি চাল চায়, ডাল চায়, জমি চায়, প্লট চায়, ফ্ল্যাট চায়? ইন্সুরেন্স চায়, ট্যুরে যেতে চায়?

ধান্দাবাজ কল হলেও এই কলগুলো এলে তবুও মনটা ভাল লাগে। যাক, তবুতো কেউ জানতে চাইল, যে, আমার মন কী চায়।

তবে দুঃখের কথা হল, এই শুভাকাঙ্খীরা কখনোই জানতে চান না, আমার সত্যি সত্যি কী চাই।

তো, এইসব অচেনা, অজানা সুহৃদদের উদ্দেশ্যে এ আমার খোলা চিঠি।

প্রিয় সেলস টিমের ভাইয়েরা ও বোনেরা,

যারা আপনারা চাল, ডাল, তেল, নুন, কনডম, ফ্ল্যাট, প্লট, এসি, পলিসি, গাড়ি, লোন-এসব বেচার দায়ীত্বে আছেন আর মাঝে মধ্যেই চোরা ও অন্যায্য পথে সংগ্রহ করা আমার নম্বরে ফোন করে খোঁজ নেন-

”কী, নাগবো নি?”, তারা দয়া করে জেনে রাখুন, আমার সত্যিকারে কী লাগবে-

আমার-

-একটা দারুন ও পশ চাকরি লাগবে (বিপুল বেতন ও বেনেফিটসহ)।

-একটা ফুল জিপ লাগবে (সেডান/SuV না।)

-দশ কোটি টাকা লাগবে।

-বছর খানিক নিখাঁদ অবসরে থাকার মতো সংস্থান লাগবে।

-বাইম মাছ, পুঁটি মাছ আর বেলে মাছের ঝাল ঝাল ঝোল দিয়ে এক বাসন ভাত খাবার আস্বাদ লাগবে।

-নায়াগ্রা বেড়াতে যাবার অঙ্গিকার পূরণের ব্যবস্থা লাগবে।

এগুলো মাগনা যদি আপনাদের কোম্পানী দেয়, তাহলে প্লিজ কল করুন। দিন রাতে যেকোনো সময়। মাইন্ড করব না।

এমনিতেও, এই যে, রাত ১২ টায় ফোন করেন, তাতেও খুব মাইন্ড করি না।

তবে, মোবাইল ফোন কোম্পানীর ভায়ারা, এই যে, আমার অনুমতি ছাড়া, আমার অগোচরেই আমার ফোন নম্বর ও স্টাটাস আপনারা বিভিন্ন সেলস টিমের কাছে বিক্রী করেছেন, তার জন্য আপনাদের মাথায় এই চত্তির মাসে ঠাডা পড়বার অভিশাপ দিলাম। যদি আপনারা এই চৌর্যবৃত্তিটার সাথে সাথে আমার নম্বর ও রিজিউমিটা দশজন দানবীর অথবা দশটা পশ কোম্পানীর মালিককে গোপনে পাঠান, তাহলেই শুধু এই অভিশাপ কাটবে।

সময়, সে তো মরিচিকা:

আমাদের সারাটা জীবনই আমরা কোনো এক অজানা, অদেখা, অচেনা ’ভবিষ্যত’ এর কথা ভেবে কৃচ্ছতা, আত্মত্যাগ, স্বার্থত্যাগ করে যেতে থাকি।

সত্য ও পরিহাসের বিষয় হল, সেই ‘ভবিষ্যত’টা কখনোই জীবনে ধরা দেয় না।

কল্পিত বা অনুমিত সেই ‘ভবিষ্যত’ কখনো আসে না। এ কূলও যায়, ও কূলও। কল্পিত ‘ভবিষ্যত’ এর আশায় বাস্তবের ‘বর্তমান’ও শুকায়। লুটায়।

ঠিক তেমনি, আমাদের সারাটা জীবনই আমরা ”ভবিষ্যতে কাজে আসবে” ভেবে অনেকের জন্য অনেক কিছু করি।

”ভবিষ্যতে কাজে দেবে” ভেবে কত জনের সাথে সখ্য গড়ি, কত জনের কত অপরাধ হজম করি, কত জনের কত অন্যায় আব্দার রাখি।

এক কল্পিত ‘ভবিষ্যত’ এর কথা ভেবে কত জনের জন্য নিজেকে করাতে দু’খান করে আবার জুড়ে দেখাবার, বাঁদর নাচ দেবার কসরত করি।

কিন্তু, সেই সুসময়ের আলবাট্রসরা কখনোই আমাদের ভবিষ্যতের পৃথিবীতে সাদা ডানা নিয়ে উড়ে আসে না আমাদের জীবনে।

এমনকি, ভবিষ্যতের পৃথিবীটাতে, মানে আমাদের নিশ্চল বৃদ্ধ বয়সে সামান্য সঙ্গ দেবার জন্যও সাদা ডানা সেসব অতীতের আলবাট্রসকে আর জীবনের দিগন্ত রেখায় দেখা যায় না। কখনোই।

দিন শেষে আমরাই থাকি, আমাদের জন্য। আমি থাকি আমার জন্য। বাকিটা কেবলই অভিনয়।

কে শুধাবে ঠাকুরেরে:

ছোট্ট মফস্বল নগরের জাগ্রত নগর দেবতার মন্দীর। ইচ্ছাপূরণ দেবতাও তিনি বটেন।

লোকে লোকারণ্য। কাতারে কাতারে ভক্ত, কৃপাপ্রার্থী লুটায় মন্দীরের চাতালে।

বেকার যুবক সেখানে হত্যে দেয় একটা চাকরির আশায়।

’বাঁজা মেয়েছেলে’ কুসুম দুই হালি মর্তমান কলা ভেট দিয়ে মিনতি জানায় একটা সন্তানের জন্য।

সতীনের মৃত্যু কামনা করে ইচ্ছেপূরণ দেবতার পায়ে নৈবেদ্য উজাড় করেন বড় বাড়ির গিন্নী মা।

ছিঁচকে চোর ছমিরও এসেছে মনোঃস্কামনা পূরণের জন্য। ঠাকুরের কাছে জোড়া হাত নিয়ে কামনা জানায় তালুকদার বাড়ির ভাড়াড় হতে ক্ষুধার চাল চুরির মিশন সফল হবার জন্য। চুরি সফল হলে সেখান হতে পুরো তিন হাতা চাল ইচ্ছেপূরণ দেবতাকে উৎসর্গ করবার মানত তার।

ষোড়ষী দেবকী এসেছে প্রেমিক ছলেমানকে যেন সে নিজের করে পায়-তার অনুরোধ নিয়ে। দেবকীর এই অসম ও অসঙ্গত দাবীর নিবেদনে দেবতা অদৃশ্য হতে সামান্য মুচকী হাসেন।

দুই বউওয়ালা বড় বাড়ির কর্তা ঘোষাল বাবুও গোপনে হাজিরা দেন ইচ্ছেপূরণ দেবতার মন্দীরে। দুই বউয়ের মধ্যে যেন শান্তি ও সন্ধি বজায় থাকে-তার মানতের ভেট নিয়ে দেবতার সাথে দরকষাকষি করেন ঘোষাল কর্তা।

ছোট্ট পূঁটি বড়াল বাড়ির ফটকের বড় রক্তকরবী গাছটা হতে ঝড়ে পড়া এক মুঠো নেতানো রক্তকরবী নিয়ে ঠাকুরের বিগ্রহের পদপ্রান্তে নিবেদন করে; মা’টা যেন এবারের মতো না মরে বেঁচে যায়; বাড়ি হতে তিন মাস ধরে অন্তর্ধান বাপটা যেন ঘরে ফেরে।

প্রধান পুরোহিতের জোয়ান বউ বিমলা দেবী দন্ডী কেটে মন্দীরের চাতাল অব্দি এসেছে। মরো মরো স্বামীটা যেন এবারের মতো জমরাজের হাত হতে নিস্তার পায়, সিঁথীর সিদুঁর যেন অক্ষয় থাকে-তার জন্য দেবতাকে জোড়া পাঁঠা মানত মানেন।

রাত গভীর হলে মন্দীরের জোয়ান সেবায়েত এসে চুপি চুপি হাত জড়ো করে ঠাকুরকে তিন ফানা মর্তমান কলা সাধেন, মন্দীরের প্রধান পুরোহিত, যে গত মাসাধিককাল যক্ষায় মরো মরো, সে যেন এবার দেহ রাখে আর তার পুরোহিত হবার পথটা যেন সুগম হয়। হয়তো পুরুতের জোয়ান বউটাও তার মানতের কামনায় অবচেতনে ঢুকে পড়ে।

নগর দেবতার মন্দির দালানের ঘুলঘুলিতে বাসা বাঁধা চড়ুই দম্পতি ঠোটে করে আনা দুটো দুর্বার ডগা বিগ্রহের পায়ে ফেলে মিনতি জানায়, এবারের জোড়া ডিম হতে সদ্যই ফোটা ছানারা যেন চাতাল ঢেকে রাখা মেঘ শিরীষ গাছটার কোটরে বাস করা কাল নাগিনটার পেটে না যায়।

মন্দীরের চাতালটাকে ছায়ায় ঢেকে রাখা মেঘ শিরীষ গাছটাও রাত নামলে, ভীড় কমলে দেবতার কাছে নিজের প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করে; মন্দীরের কমিটিকে গেল হপ্তায়ই মন্দীরের সংস্কারের জন্য তহবিল জোগাড় করতে শতবর্ষী গাছটাকে কেটে বিক্রী করে দেবার আলাপ করতে সে শুনে ফেলেছে।

ইচ্ছেপূরণ দেবতা সবার নিবেদনই নিরবে, অদৃশ্যে বসে বসে শোনেন। কারো কথায় সামান্য বিচলিত হন, কারো মিনতি শুনে মন ভার করেন। কারো নিবেদন শুনে ক্রূদ্ধ হন। সবার সব অনুনয়, সব অনুরোধ, সব ইচ্ছের, সব প্রয়োজনের দাবী তার কাছে।

যদিও কেউ কখনো খোদ ইচ্ছে পূরণ দেবতাকে শুধোয়নি, যে, তার কী চাই। তার কী প্রত্যাশা রয়েছে, তার কোনো ইচ্ছে আছে কিনা। সবার ইচ্ছে পূরণের রঙীন কাইতন বাঁধা পড়ে যে দেবতার চরণে, খোদ সেই মনোঃস্কামনা পূরণের দেবতারই কোনো অপূর্ণতার আক্ষেপ রয়ে গেছে কিনা কে তার খোঁজ রাখে? তার চাওয়া পূরণ করবে কে? শুনবে অন্তত কে?

মানুষেরা, ভক্তেরা তাদের আরাধ্য দেবতার মন্দিরে গিয়ে তার কাছে কত কিছু চায়, কত আবেদন জানায়, কত নালিশ করে, নিজের কত অভাব, অভিযোগ ও প্রত্যাশা ব্যাকুল হয়ে ব্যক্ত করে।

কিন্তু, কোনো ভক্ত কি কোনোদিন দেবতাকে জিজ্ঞেস করেছে, যে, তারও কিছু অভিযোগ আছে কিনা, কিংবা, তারও কিছু চাই কিনা। নিজের অনুযোগ তো মাথাকুটে দেবতাকে জানায়, কিন্তু, খোদ সেই দেবতার মনেই কোনো অপূর্ণতা, না পাওয়ার বেদনা, কোনো অভাব আছে কিনা-তাকে কে শুধায়?

সবাই ভাবে, সে তো দেবতা। সে নিজেই সবার আশা পূরণ করে। তার আবার কীসের অভাব, চাওয়া।

লিংকডইনে কেন এই ফেসবুক আহাজারি? 

এই যে, বলছি। 

এই যে আমি আপনি নানাজনকে কমেন্টে, ইনবক্সে চাকরি পাওয়ার জন্য মেসেজ দিই, আমরা কি কখনো কাউকে মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করেছি, “ভাই, আপনার কি চাকরি বাকরি নিয়ে সমস্যা আছে, চাকরি খুঁজছেন কি, একটা চাকরির সুযোগ আছে, আপনার আগ্রহ আছে কি?” 

দরিদ্র একটি দেশে, বেসরকারী সেক্টরের বিপুল প্রাবল্যের দেশে যেকোনো বিচারে ‘চাকরি’ই হল সবচেয়ে বড় অভাব ও আরাধ্যের নাম। বিভিন্ন জনকে নিজের প্রয়োজনের কথাটি বলে সাহায্য তো আমরা চাই। তো, আমরা নিজেরা কি কখনো সেই আইকন, সেই ‘বড় ষাড়’কে শুধিয়েছি, “ষাড়, চাকরিবাকরি ভাল চলছে কি? আপনার কি চাকরিবাকরি দরকার?” নাহ, শুধাইনি।

বড় বড় স্যার, বড় বড় পজিশনে বসে আছেন মানেই এটা নয়, যে, তারা সর্বৈব সুখে আছেন, তাদের কোনো প্রত্যাশা ও অভাব নেই।

মানুষ যত বড় হয়, তার পেটটাও তত বড়-সেটা মনে রাখবেন।

#callofmind #inatelonging #innerobjective #needoflife #myexpectation #innerdesire #unseenfuture #imagineryfuture #ambiguiousexpectation #fulfilmentofGod #wailingofGod #beingselfish #willpower #prayertoGod #cravingofmind

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *